কুলদীপ বটব্যাল। —নিজস্ব চিত্র।
ছেলেমেয়েগুলোর খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে নাকি! তরুণ হস্টেল সুপারের মসৃণ কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠল লকডাউনে জারি হওয়া বিধিনিষেধের লিস্টে চোখ রেখেই।
অতিমারির আবহে লকডাউনের আগে থেকেই ঝাঁপ ফেলে দিয়েছে একের পর এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। জমায়েতের সম্ভাবনা নির্মূল করতে হস্টেল খালি করে দিয়েছে বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু এ যে মেডিক্যাল কলেজের হস্টেল। খালি করার উপায় তো নেই। হাসপাতাল তো আর ঝাঁপ ফেলতে পারবে না। অতএব হস্টেল খোলা রাখতেই হবে। বিধিনিষেধ যতই থাক, হস্টেলের ক্যান্টিনে খাবার-দাবারের সাপ্লাই লাইনটা ঠিক রাখতেই হবে।
বছর আঠাশের যুবক কুলদীপ বটব্যাল চিকিৎসা বিজ্ঞান ভাল ভাবে রপ্ত করেছেন। কিন্তু লকডাউনের মতো অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে কী ভাবে প্রশাসনকে মসৃণ রাখতে হবে, সে সব তাঁর জানার কথা নয়। এই লকডাউন এমনই এক নজিরবিহীন ঘটনা যে, দুঁদে আইএএস আধিকারিকদেরও মাথার ঘাম পায়ে পড়ছে ব্যবস্থাপনা মসৃণ রাখতে। সেখানে একজন চিকিৎসককে যদি প্রশাসনিক দায়িত্ব সামলাতে দেওয়া হয়, তা হলে প্রাথমিক ধাক্কায় তিনি কতখানি দিশাহারা বোধ করতে পারেন, বুঝতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু দায়িত্ব তো সামলাতেও হবে। মেডিক্যাল কলেজের হস্টেল সুপার পদই হোক বা হাসপাতাল সুপার, এ সব প্রশাসনিক পদ চিকিৎসকদেরই সামলাতে হয়। তবে সে সব তো এতদিন সামলাতে হত স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে। এমন অস্বাভাবিক এবং অভূতপূর্ব দিন কখনও দেখেনি ভারত। গোটা দেশ যখন লকডাউন হয়ে পড়ে রয়েছে, শুধুমাত্র নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর পরিবহণ ছাড়া আর সব যখন বন্ধ, স্থানীয় বাজার-দোকানে যখন সে সব সামগ্রীও সব সময় ঠিক মতো মিলছে না, তখন কী ভাবে হস্টেলের জন্য প্রয়োজনীয় সব জিনিসের সরবরাহ মসৃণ রাখবেন, সে কথা তরুণ চিকিৎসকের জানার কথা নয় একেবারেই। অতএব নিজের রাজনৈতিক যোগাযোগ কাজে লাগানোর পথ নিলেন কুলদীপ।
আরও পড়ুন: পাড়ার দোকানে তাও ওয়াক ফ্রম হোম, নামীদামি মিষ্টিরা ছুটিতেই
উত্তর চব্বিশ পরগনার পানিহাটিতে সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালন ব্যবস্থা অনেক দিন ধরেই আস্থাশীল রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী মদন মিত্রের উপরে। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কামারহাটিতে জিতেছিলেন তৃণমূলের টিকিটে। রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীও ছিলেন। সেই সময় থেকেই ওই হাসপাতালের সঙ্গে নিবিড় যোগ মদনের। আর প্রোগ্রেসিভ জুনিয়র ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশনের রাজ্য স্তরের নেতা হওয়ার সুবাদে মদনের সঙ্গে নিবিড় যোগ কুলদীপ বটব্যালের। অগত্যা মধুসূদন, ফোন গেল মদন মিত্রের কাছে। এমনিতেই প্রতিদিন এমন নানা অনুরোধ-উপরোধের চাপ সানন্দে সামলান মদন। সকাল থেকে লোক-লস্কর নিয়ে নিয়মিত অফিস খুলে বসে থাকেন এই সব সামলানোর জন্যই। কাজের ধাঁচটাও একেবারে পুরনো কংগ্রেসি ঘরানার— চেনা-অচেনার বালাই নেই, রাজনৈতিক রং দেখার প্রশ্নই নেই, সাহায্য চাইতে যিনিই আসবেন, তাঁরই পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করা। সুতরাং সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে স্নেহভাজন তরুণ চিকিৎসকের ফোন পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তৎপর হলেন মদন মিত্র। খাবার থেকে জ্বালানি, মশলাপাতি থেকে বাসন ধোওয়ার সাবান বা স্ক্রাব প্যাড— সব কিছুর সরবরাহ যাতে ঠিক থাকে, সে ব্যবস্থা বেশ মসৃণ ভাবেই হয়ে গেল।
কিন্তু এই সাপ্লাই লাইন নিশ্চিত করার পরে যাঁর কপালের ভাঁজটা কমেছে, সেই তরুণ হস্টেল সুপারের সকাল-বিকেল-রাত কিন্তু অত মসৃণ ভাবে কাটছে না। হস্টেলে যাতে কোনও ভাবেই সংক্রমণ ঢুকতে না পারে, সে বিষয়ে সারাক্ষণ সতর্ক থাকতে হচ্ছে তাঁকে এখন। করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পরে সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও আইসোলেশন ওয়ার্ড খোলা হয়েছে। ১০টি শয্যার মধ্যে ৫-৬টিতে সব সময়ই রোগী থাকছেন। করোনার উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হচ্ছেন বলেই ওই ওয়ার্ডে রাখা হচ্ছে। এঁদের মধ্যে ক’জনের রিপোর্ট পজিটিভ আসছে, ক’জনের নেগেটিভ, সে সব তথ্য নিয়ে আলোচনায় আগ্রহী নন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু আইসোলেশন বিভাগে বা হাসপাতালের অন্যান্য বিভাগে যাঁরা নিয়মিত কাজ করছেন বা যাওয়া-আসা করছেন, তাঁরা যাতে আপাতত হস্টেলে বা হস্টেলের ক্যান্টিনে না যান, সেটা সকলে মিলেই দেখভাল করছেন। অতএব কুলদীপ বটব্যাল নিজে হস্টেল সুপার হওয়া সত্ত্বেও এখন আর হস্টেলে ঢুকছেন না। ক্যান্টিনে খেতেও যাচ্ছেন না।
অতিমারি সত্ত্বেও হাসপাতাল তো আর ঝাঁপ ফেলতে পারবে না। —নিজস্ব চিত্র।
বাইপাস সংলগ্ন এলাকায় ফ্ল্যাট কুলদীপের। তিনি যে বিভাগে রয়েছেন, সেই রেডিওলজির বিভাগীয় প্রধান কোনও কোনও দিন হাসপাতালে যাওয়ার সময়ে নিজের গাড়িতে তুলে নিচ্ছেন কুলদীপকে। সেই দিনগুলোয় সকাল ১০টা-সাড়ে ১০টায় বেরচ্ছেন। আর যে দিন সে সুযোগ নেই, সে দিন মেডিক্যাল কলেজের বাস আসছে। সকাল ৭টার মধ্যে সেই বাসে উঠে পড়তে হচ্ছে। আর ফিরতে হচ্ছে সন্ধ্যার পরে। আইসোলেশন ওয়ার্ডে যেতে হচ্ছে না কুলদীপকে। কিন্তু আইসোলেশনে না গেলেও পিপিই সংক্রান্ত নির্দেশিকা তাঁদের জন্যও রয়েছে। সেই নির্দিষ্ট পোশাকের ভিতরেই কাটাচ্ছেন দিন। এবং ভুলেও হস্টেল বা তার ক্যান্টিনের দিকে পা বাড়াচ্ছেন না। হস্টেল প্রশাসনের যাবতীয় কাজ ফোনেই সারছেন হাসপাতালে বসে।
আরও পড়ুন: লকডাউন উঠলেই বিদেশে আটকে পড়াদের ফেরানো হবে, প্রস্তুতি কেন্দ্রের
আবাসিকদের থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত হয়তো সুরক্ষিত করে ফেলেছেন তরুণ চিকিৎসক, নিজেরটা কিন্তু পারেননি। কলকাতার ফ্ল্যাটে একাই থাকেন, মা-বাবা ঝাড়গ্রামে। সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে আর একবারের জন্যও ঝাড়গ্রামে যাননি। আগে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই ছুটির দিনে পৌঁছে যেতেন জঙ্গল-ঘেরা লালমাটির শহরে। সারা সপ্তাহ যেমন-তেমন খেয়ে যে কাটিয়ে দেয় ছেলে, সে কথা মা জানেন। তাই সপ্তাহান্তে জমিয়ে রেঁধে সেই খামতি পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেন। কিন্তু এখন বাবা-মায়ের সুরক্ষার কথা ভেবে আর ঝাড়গ্রাম যাচ্ছেন না কুলদীপ। সারা সপ্তাহ নিজেই রান্না করে খাচ্ছেন।
তরুণ চিকিৎসক তা হলে রান্নাতেও দড় বলতে হবে! সংক্ষিপ্ত হাসেন কুলদীপ। তার পরে বলেন, ‘‘হ্যাঁ, দড়ই বটে। সকালে হাসপাতালে যাওয়ার আগে রোজ রান্না করে খেয়ে যাওয়ার চেষ্টাই করছি। ভাত, ডাল সেদ্ধ, আলু সেদ্ধ, ডিম সেদ্ধ। এটুকু করে নিতেই পারি।’’ তার পরে আরও এক দফা মুচকি হেসে বলছেন, ‘‘এইটুকু সকাল সকাল হয়ে গেলে, সারা দিনের জন্য অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়ে যাচ্ছি। না খেয়ে অন্তত থাকতে হবে না। এখন ওতেই চলবে। খালি পেটে না থাকা এবং যা-ই খাই, তা যেন স্বাস্থ্যকর হয়। করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য ওটাই যথেষ্ট।’’ কিন্তু রাতে? একটু দম নিয়ে কুলদীপ বলেন, ‘‘হাসপাতাল থেকে ফিরে রোজ রাতে আর রান্না করার এনার্জি থাকছে না। তাই রাতে অন্য কিছু খেয়ে নিচ্ছি।’’ কী খাচ্ছেন? স্মিত হেসে তরুণ চিকিৎসক বলেন, ‘‘ওই মুড়ি বা কর্নফ্লেকস।’’
আরও পড়ুন: প্রাণঘাতীও হতে পারে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন, বলছেন বিজ্ঞানীরা
২৩ মার্চ জন্মদিন ছিল। ঝাড়গ্রামের বাড়িতে ফিরবেন বলে ঠিক করে রেখেছিলেন। কিন্তু তার আগেই আগে জানতে পারেন, ২২ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে ‘জনতা কার্ফু’ পালিত হবে গোটা দেশে। তার পরে যে আরও বড় কিছু আসতে চলেছে, সে আঁচও পেতে শুরু করেছিলেন সিনিয়রদের সঙ্গে এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে। সংক্রমণ যে ভাবে বাড়ছে দেশ জুড়ে, তাতে কত দিন বাড়ি এড়িয়ে থাকতে হতে পারে, সে সব নিয়ে নিজের মধ্যে ভাবনা-চিন্তা তো চলছিলই। তাই ২৩ মার্চ একবার অন্তত মা-বাবাকে দেখে আসার ইচ্ছা ছিল। ও দিকে ঝাড়গ্রামেও প্রতীক্ষা চলছিল একই রকম অধীর আগ্রহে। কেক, পায়েস, মিষ্টি সব আয়োজন সারা, শুধু ছেলে বাড়ি ফেরার অপেক্ষা। কিন্তু ২৩ মার্চ সকাল থেকেই পরিস্থিতি বদলে গেল। প্রশাসনিক স্তরে তৎপরতা আচমকা বাড়ল। দুপুরে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করে দিলেন যে, সব পুর এলাকা এবং জনবহুল এলাকায় লকডাউন। বাড়ি আর ফেরার উপায় ছিল না। কারণ বাড়ি ফিরলে হাসপাতালে ফিরতে পারা অনিশ্চিত হয়ে পড়ত। আর তার পরে তো গোটা রাজ্য তথা গোটা দেশই লকডাউনে চলে গেল। অতএব জন্মদিনেও মা-বাবাকে দেখে আসাটা এ বার আর হয়নি কুলদীপ বটব্যালের।
তিনি ফিরতে পারছেন না জেনে মা-বাবার প্রতিক্রিয়া? কুলদীপ আর কথা বলতে চান না সে প্রসঙ্গে। তাঁর নিজেরও গলা ভারী হয়ে আসে। তবে মুহূর্তেই সামলে নেন। চেনা উজ্জ্বল হাসিটা চট করে ফিরিয়ে এনে বলেন, ‘‘অসুবিধা নেই। ক’টা দিন একটু কষ্ট করতে হচ্ছে। কিন্তু এই সময়ে আমরা কষ্ট না করলে আর কে করবে!’’
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)