ছাগল চরিয়ে বাড়ি ফিরছে চতুর্থ শ্রেণির এক ছাত্রী। হাসনাবাদে। নিজস্ব চিত্র।
বেঙ্গালুরুর ট্রেনের টিকিট কাটা হয়ে গিয়েছে সাগর মণ্ডলের। ১৩ জুলাই ট্রেন। দিনমজুরির কাজ পেয়ে গিয়েছে যোগেশগঞ্জ স্কুলের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রটি। তার কথায়, ‘‘ক্লাসের আর এক বন্ধুর সঙ্গে যাব। আমাদের মতো গরিব পরিবারে রোজগার করলে তবু কিছু সুবিধা হবে।’’ এত দিন ধরে স্কুল বন্ধ। পড়ার ব্যাপারে আর আগ্রহ নেই বলে জানায় সাগর।
ছেলের সিদ্ধান্তে অমত নেই বাবা সুপদর। তিনি নিজেও কাজের খোঁজে ভিন্ রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছেন বলে জানালেন। সুপদর কথায়, ‘‘ইচ্ছে ছিল ছেলেটা উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে কলেজে ভর্তি হবে। একাদশ শ্রেণিতে চার হাজার টাকার বই কিনে দিয়েছিলাম। এক সপ্তাহও ক্লাস হল না।’’ সাগর জানায়, অনলাইনে ক্লাস করার মতো ভাল ইন্টারনেট সংযোগই মেলে না গ্রামে।
হাসনাবাদ ব্লকের গোয়ালআটি গ্রামের বাসিন্দা রবিউল গাজি চকপাটলি হাইস্কুলের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। তার কথায়, “বাড়ির আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। স্কুল বন্ধ, তাই এখন দিনমজুরি করছি। স্কুল খুললে হয় তো যাওয়ার চেষ্টা করব। এখনও সে ভাবে ভাবিনি কিছু।’’ রবিউলের বাবা মতলব গাজি বলেন, ‘‘দিনমজুরি করে ছেলের বই-খাতা কেনা, গৃহশিক্ষকের খরচ চালানো কঠিন হয়ে পড়ছিল। ছেলে কাজ খুঁজে নেওয়ায় পরিবারের আয় সামান্য হলেও বেড়েছে।’’
আড়াই মাস হল তামিলনাড়ু চলে গিয়েছে হিঙ্গলগঞ্জের বাঁকরা গ্রামের নীলিমা ও নীহার। হিঙ্গলগঞ্জ হাইস্কুলে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ত নীলিমা। তার ভাই নীহার ওই স্কুলেই নবম শ্রেণির ছাত্র। মা অনিমা মণ্ডল বলেন, “আমাদের গরিব পরিবার। তাই ছেলেমেয়েদের নিয়ে এলাম কাজের খোঁজে। এখানে আমাদের সঙ্গে ওরা কারখানায় যায়। সেলাইয়ের কাজ শিখছে। এখন তো স্কুলও বন্ধ।”
সাগর-রবিউল-নীহারদের মতো বহু ছেলেমেয়ে পড়া ছেড়ে ইদানীং রোজগারের পথ খুঁজে নিচ্ছে। করোনায় প্রায় দেড় বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ স্কুল-কলেজ। মাঝে কিছু ক্লাস শুরু হলেও ফের সে সব শিকেয় উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে সুন্দরবনের গ্রামে গ্রামে স্কুলছুটের সংখ্যা বাড়ছে বলে জানাচ্ছেন শিক্ষকেরা। বিষয়টি খোঁজখবর নিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন উত্তর ২৪ পরগনার জেলাশাসক সুমিত গুপ্ত।
পড়ুয়াদের এই প্রবণতা নিয়ে উদ্বিগ্ন শিক্ষক মহল। বিভিন্ন স্কুলের প্রধান শিক্ষকেরা জানালেন, গ্রামাঞ্চলে অনলাইনে পড়াশোনা অনেক ক্ষেত্রেই ফলপ্রসূ হয়নি। নেটওয়ার্কের সমস্যা, মোবাইলের নেটপ্যাকের বাড়তি খরচের ধাক্কা অনেক পরিবার সামলে উঠতে পারেনি। আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় বহু অভিভাবক ছেলেমেয়েদের স্মার্ট ফোনও কিনে দিতে পারেননি। তা ছাড়া, অনলাইন পড়াশোনার সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারেনি অনেকে। পড়ার আগ্রহ হারিয়েছে তারা। কাজ খুঁজে নিতে শুরু করেছে এলাকায়। অনেকে পাড়ি দিয়েছে ভিন্ রাজ্যে। কিছুটা আর্থিক সুরাহা হওয়ায় অভিভাবকেরাও তাতে অমত করেননি।
বায়লানি দুর্গাপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক সমীরকুমার মান্না বলেন, “আগে স্কুলছুট পড়ুয়াদের বাড়ি গিয়ে তাদের স্কুলে এনে ক্লাসে ধরে রাখা হত। এখন স্কুল বন্ধ থাকায়, তা সম্ভব হচ্ছে না।’’
দুলদুলি মঠবাড়ি ডিএন হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক পলাশ বর্মণ বলেন, “আমাদের নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত অন্তত ৩০ শতাংশ পড়ুয়া পড়াশোনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।”
সন্দেশখালি ১ ব্লকের ন্যাজাট হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক অসীম গায়েন বলেন, “করোনার পাশাপাশি বার বার প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সুন্দরবনের গ্রামের দরিদ্র পরিবারের পড়ুয়ারা। এ দিকে, দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় পড়াশোনার অভ্যাসও চলে যাচ্ছে। পড়া ছেড়ে দিচ্ছে অনেকে।”
হিঙ্গলগঞ্জ চক্রের স্কুল পরিদর্শক মহম্মদ নিজামুদ্দিন জানান, বিভাগীয় নির্দেশে বছরে একবার করে পার্শ্বশিক্ষকদের নিয়ে এলাকা ধরে ধরে সমীক্ষা করা হয়। কেউ স্কুলছুট হয়ে গেলে তালিকা তৈরি করে স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করা হয়। তাঁর কথায়, ‘‘যদি কেউ মাঝপথে পড়া ছেড়ে দেয়, তাদের উপরে আমাদের নজর আছে। তাদের আবার স্কুলে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে।’’