মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র
আরও কঠোর পদক্ষেপ করল রাজ্য সরকার। করোনা পরিস্থিতির মোকাবিলায় গোটা রাজ্যেই লকডাউন ঘোষণা করে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ অর্থাৎ মঙ্গলবার বিকেল ৫টা থেকে রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়ে যাচ্ছে। ২৭ মার্চ পর্যন্ত আর নয়, ৩১ মার্চ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে লকডাউনের সময়সীমা।
গত কাল অর্থাৎ সোমবার থেকে রাজ্যে আংশিক লকডাউন কার্যকরী হয়েছিল। রাজ্যের প্রায় সব পুরসভা এবং আরও অনেক জনবহুল জনপদকে সেই লকডাউনের আওতায় আনা হয়েছিল। রবিবার অর্থাৎ জনতা কার্ফুর দিন বিকেলের দিকে নবান্ন থেকে বিজ্ঞপ্তি জারি করে সেই লকডাউনের কথা ঘোষণা করা হয়। এ দিন অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী নিজে সাংবাদিক সম্মেলন করে লকডাউনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন।
আগে যে আংশিক লকডাউন ঘোষিত হয়েছিল, শুক্রবার মধ্যরাতে তার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী এ দিন তার মেয়াদ বাড়িয়ে দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেন। ৩১ মার্চ মধ্যরাত পর্যন্ত কলকাতা থেকে শুরু করে রাজ্যের প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত সর্বত্র এই লকডাউন কার্যকরী থাকছে। অর্থাৎ আগামী ৮ দিন নিত্যপ্রয়োজনীয় এবং অত্যাবশ্যক পরিষেবা ছাড়া সব কিছু বন্ধ থাকবে পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র।
আরও পড়ুন: লকডাউন না মানলে প্রয়োজনে কার্ফু জারি করার পরামর্শ রাজ্যকে
খুব প্রয়োজন না পড়লে কেউ রাস্তায় বেরোবেন না, একটু দুর্ভোগ সহ্য করতে হলেও বাড়িতেই থাকার চেষ্টা করুন— মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন এই আহ্বান জানিয়েছেন রাজ্যবাসীর উদ্দেশে। জরুরি কাজে বাইরে বেরতে হলেও যাতে কেউ পরস্পরের কাছাকাছি না দাঁড়ান, সে কথাও এ দিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফের মনে করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘হাতজোড় করে বলছি, দূরে দূরে দাঁড়ান।’’
সোমবার থেকে রাজ্যে আংশিক লকডাউন কার্যকরী হলেও বিভিন্ন এলাকা থেকেই সরকারি নির্দেশ অমান্য করে অকারণে রাস্তাঘাটে ঘোরাঘুরি করার অভিযোগ মিলছিল। সোমবার রাত থেকেই পুলিশ কঠোর পদক্ষেপ করা শুরু করেছিল লকডাউন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছে, তাতে শুধু পুর এলাকা বা জনবহুল এলাকাগুলোতে লকডাউন কার্যকরী করা যে যথেষ্ট নয়, সে পরামর্শও নবান্নের শীর্ষ মহলের কাছে বার বার পৌঁছচ্ছিল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর সময় নষ্ট করলেন না। আংশিক লকডাউন চালুর ২৪ ঘণ্টা কাটার আগেই সম্পূর্ণ লকডাউনের কথা ঘোষণা করে দিলেন।
আর্থিক ভাবে দুর্বল তথা অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকরা যাতে লকডাউনের সময়ে সমস্যায় না পড়েন, তা নিশ্চিত করতে এ দিন আর্থিক সহায়তা প্রকল্প ঘোষণা করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘প্রচেষ্টা’ প্রকল্পের আওতায় তাঁদের এক হাজার টাকা করে দেওয়া হবে বলে মুখ্যমন্ত্রী এ দিন জানিয়েছেন।
এ ছাড়া খাদ্যশস্যের সঙ্কট যাতে না হয়, তা নিশ্চিত করতে আগামী সাত দিনই রেশন দোকানগুলি খুলে রাখা হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর সাংবাদিক সম্মেলনের পরে খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেছেন, ‘‘রেশন দোকান থেকে যাঁরা খাদ্যশস্য নেন, আগামী সাত দিনই তাঁদের জন্য রেশন দোকানগুলো খুলে রাখা হবে। এই ক’দিন দু’বেলাই রেশন দোকান খোলা থাকবে। আর ১ এপ্রিল থেকে বিনামূল্যে চাল-গম দেওয়া শুরু হচ্ছে। যাঁরা ২ টাকা কিলো দরে চাল-গম পেতেন, তাঁদের এ বার মাসে মাথাপিছু ৫ কিলো করে খাদ্যশস্য (চাল-গম মিলিয়ে) বিনামূল্যে দিয়ে দেওয়া হবে।’’ রাজ্যের ৭ কোটি ৮৫ লক্ষ মানুষ এই প্রকল্পের আওতায় আসছেন বলে খাদ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন।
আরও পড়ুন: লকডাউনের প্রথম সকালে কলকাতা প্রায় জনশূন্য, আইন না মানায় গ্রেফতার ২৫৫
করোনা মোকাবিলা নিয়ে আলোচনা করতে সোমবার নবান্নে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সর্বদল বৈঠকও করেছিলেন। বিভিন্ন দলের পরামর্শ এবং প্রস্তাব সেখানে শোনেন তিনি। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে যে অনেক বেশি সহযোগিতা দরকার, সে কথাও বৈঠকে উপস্থিত বিজেপি নেতাদের জানিয়ে দেন।
বিজেপির তরফ থেকে সায়ন্তন বসু আবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন জেলাগুলোর পরিস্থিতি নিয়ে। সারা বছর ভিন্রাজ্যে বা বিদেশে কাজ করেন যে সব শ্রমিকরা, করোনা সঙ্কটের মাঝে তাঁরা যে দলে দলে নিজেদের গ্রামে ফিরেছেন এবং তাঁদের অনেকেই যে অসুস্থ, সে কথা তুলে ধরেন সায়ন্তন। তাঁরা ডাক্তারের কাছে যাচ্ছেন না, পরীক্ষাও করাচ্ছেন না, সুতরাং পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা থাকছে— মুখ্যমন্ত্রীকে এ কথাই বলেন তিনি। ওই শ্রমিকদের যাতে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়, তা নিশ্চিত করতে মুখ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন।
বিজেপি নেতার এই অনুরোধ পেয়ে তখনই মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দেন যে, জেলাশাসক এবং স্থানীয় প্রশাসনকে বিষয়টা দেখতে হবে। বাইরে থেকে যাঁরা ফিরেছেন, তাঁদের স্বাস্থ্যের উপরে নজর রাখার নির্দেশ দিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। তার পরে এ দিন থেকে গোটা রাজ্য জুড়ে লকডাউন ঘোষিত হয়ে যাওয়ায় সেই নজরদারিও আরও সহজ হল বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। জেলায় জেলায় যাঁরা বাইরে থেকে ফিরেছেন এবং অসুস্থতা রয়েছে, তাঁরা যাতে এখন একেবারেই বাড়ির বাইরে না বেরন এবং অবিলম্বে যাতে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে নেন, সে দিকে স্থানীয় প্রশাসন আরও জোর দিয়ে নজর দিচ্ছে বলে জানা গিয়েছে।