প্রতীকী ছবি।
কিছুটা কি থমকে গেল সংক্রমণ?
শনিবার রাতে স্বাস্থ্য দফতরের প্রকাশিত বুলেটিনে গত ২৪ ঘণ্টায় রাজ্যে দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা দেখে এমন প্রশ্ন করতেই পারেন সাধারণ মানুষ। কারণ, ওই পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে শুক্রবার নতুন করে (দৈনিক বুলেটিনে আগের ২৪ ঘণ্টার আক্রান্তের সংখ্যাই জানানো হয়) আক্রান্ত হয়েছেন ১৮ হাজার ৮০২ জন। বৃহস্পতিবারও রাজ্যে আক্রান্ত হয়েছিলেন ১৮ হাজার ২১৩ জন। অর্থাৎ গত কয়েক দিনে যে ভাবে লাফিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছিল ততটা বাড়েনি। তবে চিকিৎসকেরা বলছেন, এই সংখ্যা দেখে স্বস্তি মেলার কারণ নেই। রাজ্যে যে সংক্রমণের সুনামি চলছে, তা রাতারাতি কমে যাবে না। বরং এক দিনে নতুন করে ১৮ হাজার আক্রান্ত হওয়া যথেষ্ট দুশ্চিন্তার।
সংক্রমণের সুনামির পিছনে করোনা ভাইরাসের নতুন প্রজাতি ওমিক্রনকেই বেশি দায়ী করছেন চিকিৎসকেরা। সূত্রের খবর, স্বাস্থ্য দফতরের অন্দরের একটি রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, গত ৩১ ডিসেম্বর থেকে ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত রাজ্যে যতগুলি লালা রসের নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স করা হয়েছিল তার মধ্যে ৭১.২ শতাংশই ওমিক্রন। ডেল্টা প্রজাতি মিলেছে ৩.৭ শতাংশ নমুনাতে। আর কোনও ভেরিয়েন্ট পাওয়া যায়নি ৬.৭ শতাংশ নমুনায়। শল্য চিকিৎসক দীপ্তেন্দ্র সরকারের কথায়, “বোঝাই যাচ্ছে, পুরো ময়দান দখল করে নিয়েছে ওমিক্রন। এখন রিপোর্ট দেখলে দেখা যাবে হয়তো ডেল্টা উড়ে গিয়েছে। তাই বর্তমান পরিস্থিতিকে অতিমারির তৃতীয় ঢেউ না বলে, ওমিক্রনের ঢেউ বললেও বোধ হয় ভুল হবে না।”
স্বাস্থ্য দফতরের অন্দরের আরও খবর, টিকার দু’টি ডোজ় নেওয়ার পরে ওমিক্রনে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ৮১ শতাংশ মানুষ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “ওমিক্রন খুব সহজে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে এড়িয়ে প্রবেশ করতে পারে, সেটি আগেই বোঝা গিয়েছিল। বিদেশে এবং অন্যান্য রাজ্যেও একই প্রভাব দেখা গিয়েছে। সেই মতোই রাজ্যেও ওমিক্রন খেলা দেখাচ্ছে।”
চিকিৎসকেরা জানান, ডেল্টা প্রজাতির থেকেও পাঁচ গুণ বেশি সংক্রমণ ছড়ানোর ক্ষমতা রয়েছে ওমিক্রনের। এমনকি, তিন-চার দিনের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়।
অর্থাৎ এ দিন যে সংখ্যক আক্রান্ত হয়েছেন, তিন-চার দিনের মধ্যে সেটি দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে। বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালের উপাধ্যক্ষ চিকিৎসক আশিস মান্না বলেন, “ভাইরাসের ভেরিয়েন্টের দিক থেকে ওমিক্রন এখন সংখ্যাগুরু হয়ে উঠেছে। ডেল্টা, ডেল্টা প্লাসকে ছাপিয়ে ওই নতুন প্রজাতি উঠে আসছে। তবে মনে রাখতে হবে ডেল্টা কিন্তু একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে না। তাই তাতে আক্রান্তদের সঙ্কটজনক হওয়ার আশঙ্কাও থেকে যাচ্ছে।”
এখন ওমিক্রনে আক্রান্ত কিংবা সন্দেহভাজনদের আলাদা ওয়ার্ডে রেখে চিকিৎসার নির্দেশিকা রয়েছে। অচিরেই সেটি প্রত্যাহার করে সকলকে একই ওয়ার্ডে চিকিৎসা দেওয়ার নির্দেশিকা কেন্দ্র ও রাজ্যের স্বাস্থ্য কর্তাদের থেকে আসতে পারে বলেও মনে করছেন চিকিৎসকেরা।
এ দিনের বুলেটিনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বৃহস্পতিবারের মতোই শুক্রবারের দৈনিক আক্রান্ত ১৮ হাজারের ঘরে থাকলেও পজ়িটিভিটি রেট বেশি। শুক্রবারের পজ়িটিভিটি রেট ২৯.৬০ শতাংশ। যা বৃহস্পতিবারের (২৬.৩৪) থেকে ৩ শতাংশ বেশি। আবার এটাও দেখা যাচ্ছে কলকাতার পজ়িটিভিটি রেট বৃহস্পতিবারের (৪৯.০২ শতাংশ) থেকে শুক্রবার কিছুটা কম। সেটি হল ৪৮.৫৮ শতাংশ। ওই দিন
কলকাতায় আক্রান্ত হয়েছেন ৭ হাজার ৩৩৭ জন।
অন্য দিকে উত্তর ২৪ পরগনায় আক্রান্তের সংখ্যা এ বার বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। সেখানে শুক্রবার আক্রান্ত হয়েছেন ৩ হাজার ২৮৬ জন। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, শহর ছাড়িয়ে এ বার জেলাগুলিতে প্রভাব বিস্তার শুরু করবে ভাইরাস। কিন্তু প্রত্যন্ত এলাকার কত জন পরীক্ষা করাবেন তা নিয়ে সংশয় রয়েই গিয়েছে। পরীক্ষা না-করানোর বিষয়টি যথেষ্ট আশঙ্কার বলে মনে করছেন তাঁরা। কারণ, পর্যাপ্ত পরীক্ষা না-হলে কোথায় কী হারে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে তার আসল ছবি বোঝা যাবে না।
স্বাস্থ্য দফতরের অন্দরে জিনোম সিকোয়েন্সের যে রিপোর্ট এসেছে সেখানে ৬.৭ শতাংশের শরীরে করোনা ভাইরাসের কোন প্রজাতি হানা দিয়েছে তা জানা যায়নি। এই বিষয়টি নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করছেন চিকিৎসকেরা। এক সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞের কথায়, “ডেল্টার মিউটেশন হয়ে নতুন কোনও প্রজাতি তৈরি হয়েছে কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তাই প্রজাতির অজানা এমন সংখ্যা বাড়তে থাকলে তা চিন্তার হবে।” স্বাস্থ্য দফতরের অন্দরের আরও একটি খবর, গত ৩১ ডিসেম্বর থেকে ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত যত জন শিশু করোনা আক্রান্ত হয়েছে তার ৬৯.২ শতাংশ ওমিক্রনে আক্রান্ত। যদিও বড়দের মতোই শিশুদেরও উপসর্গ মৃদু থাকছে। তাড়াতাড়ি সুস্থও হয়ে উঠছে তারা। কিন্তু তার পরেও ওমিক্রনকে হালকা ভাবে নিতে নারাজ চিকিৎসকেরা। কারণ, নতুন ওই প্রজাতি ভয়াবহ কি না, তা জানার জন্য এখনও আরও কয়েকটি দিন অপেক্ষা করতে হবে।
এই পরিস্থিতিতে মানুষকে আরও বেশি সতর্ক হওয়ার পরামর্শই দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা। তাঁদের মতে, মৃদু উপসর্গ, দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠা কিংবা এক দিন ১৮ হাজারের ঘরেই সংক্রমণ আটকে থাকা, এগুলিকে হালকা ভাবে নিলে চলবে না। সব ঠিক হয়ে গিয়েছে, এটা ধরে নিলে বিপদ বাড়বে বই
কমবে না।