ত্রয়ী: মুখোশ ছাড়া তিন নেতা। মুকুল রায়, দিলীপ ঘোষ এবং সব্যসাচী দত্ত। মঙ্গলবারের পদযাত্রায়। —নিজস্ব চিত্র।
কোভিড পরিস্থিতি সামলাতে রাজ্য সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ। যার ফল ভুগতে হবে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে। একাধিক বার এমন অভিযোগ করা হয়েছে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে। সরকারি ব্যর্থতার কারণে পশ্চিমবঙ্গকে কোভিড সংক্রমণের ‘হটস্পট’ হিসেবে প্রতিপন্ন করতে চাইলেও খোদ বিজেপি নেতৃত্বই রাজ্যে এমন সব কর্মসূচি গ্রহণ করছেন, যাতে সংক্রমণের আশঙ্কা আরও বেড়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। উপর্যুপরি রাজনৈতিক বক্তৃতা বা সাংবাদিক বৈঠকের সময়ে বিজেপির সিংহভাগ নেতা-নেত্রীর মুখেই মাস্ক দেখা যাচ্ছে না।
ফলে এক দিকে পশ্চিমবঙ্গে কোভিড পরিস্থিতি ‘খারাপ’ বলে দাবি করার পরেও কেন বিজেপি নেতারা নিজেরাই এমন সব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন, যাতে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। অবশ্য শুধু বিজেপি নেতৃত্বই নন, রাজনৈতিক সভা-মিছিলে কোনও দলের তরফেই করোনা-বিধি মানা হচ্ছে না বলে জানাচ্ছেন তাঁরা। এক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ জানাচ্ছেন, ধরা যাক এক জন নেতা মাস্ক না পরেই মাইক্রোফোনে বক্তৃতা দিচ্ছেন। তাঁর বক্তৃতার পরে সেই মাইক্রোফোনই ব্যবহার করছেন অন্য এক জন বক্তা। এ ভাবে কোনও রকম সুরক্ষাকবচ ছাড়াই মাইক্রোফোন হস্তান্তরের মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। ওই বিশেষজ্ঞের কথায়, ‘‘কে সংক্রমিত আর কে নন, সেটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বোঝা যাচ্ছে না। এ বার কোনও সংক্রমিত ব্যক্তি মাইক্রোফোনে কথা বলার পরে যদি তা পরবর্তী বক্তার হাতে তুলে দেন, তা হলে মাইক্রোফোনে লেগে থাকা তাঁর মুখ নিঃসৃত তরল কণা বা ড্রপলেটের মাধ্যমে সংক্রমণ সংশ্লিষ্ট বক্তার শরীরে ছড়াতে পারে।’’
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের তথ্য বলছে, মোট সংক্রমিত রোগীর নিরিখে মঙ্গলবার পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ রয়েছে অষ্টম স্থানে। এক ভাইরোলজিস্টের বক্তব্য, দেশে সংক্রমণ শুরুর প্রাথমিক পর্বে দিল্লির এক জমায়েতের মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়িয়েছে, সেটা কেন্দ্রের তরফে জানানো হয়েছিল। তাঁর কথায়, ‘‘কিন্তু কেন্দ্রে আসীন শাসক দলের নেতা-নেত্রীরা যে ভাবে সভা-মিছিল করে চলেছেন প্রতিনিয়ত, তাতেও তো একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার আশঙ্কা থাকছে।’’
আরও পড়ুন: শুধু মন্ত্রিত্বই নয়, এক মহিলার জন্য সন্তানও ছেড়েছেন শোভন: রত্না
আরও পড়ুন: কোভিড টিকা কারা, কী ভাবে পাবেন, আনন্দবাজার ডিজিটালে পড়ে নিন
যদিও তাদের সভা-মিছিলের মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে, এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বিজেপি নেতৃত্ব। পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিজেপির এক শীর্ষ নেতার দাবি, ‘‘সব সতর্কতা মেনেই সভা-মিছিল করা হচ্ছে।’’
বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ আবার জানাচ্ছেন, বাংলায় করোনা সংক্রমণ কমে গিয়েছে। তবে তার জন্য রাজ্য সরকারের কোনও ভূমিকা নেই। তাঁর কথায়, ‘‘অনেক বিশেষজ্ঞ তো অনেক কিছু বলেছিলেন। বলা হয়েছিল, দুর্গাপুজোর পরে সংক্রমণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়বে। কিন্তু তা তো হয়নি। বাংলার মানুষের কাছে করোনা হেরে গিয়েছে। ফলে সভা-মিছিল থেকে সংক্রমণ মোটেই ছড়াচ্ছে না।’’
যার পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্যের মন্ত্রী তথা শাসক দলের বর্ষীয়ান নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায় দাবি করছেন, উত্তর ২৪ পরগনা-সহ রাজ্যের বেশ কয়েকটি জায়গায় করোনা সংক্রমণ ছড়ানোর পিছনে বিজেপি নেতৃত্ব দায়ী। তাঁর কথায়, ‘‘বিজেপি নেতারা তো কোনও কথা ভেবে বলেন না। তথ্য দিয়েও বলেন না। রাজনৈতিক স্বার্থ পূরণে ভুল তথ্য দিয়ে মানুষকে শুধু বিভ্রান্ত করেন।’’
যদিও বিশেষজ্ঞদের একাংশের বক্তব্য, কেন্দ্র-রাজ্য নির্বিশেষে শাসক-বিরোধী, সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বকেই সংক্রমণ রোখার ক্ষেত্রে দায়িত্ব নিতে হবে। ‘ওয়ার্ল্ড সোসাইটি ফর ভাইরোলজি’-র প্রেসিডেন্ট এবং ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমি’-র এমেরিটাস বিজ্ঞানী অনুপম বর্মা বলেন, ‘‘সভা-মিছিলের মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে কি না, তা আমরা জানি না। কিন্তু আমরা এটা জানি, এক জন সংক্রমিত ব্যক্তি কত জনকে সংক্রমিত করতে পারেন! ফলে কর্মী-অনুগামীরা যাতে মাস্ক পরেন বা করোনার সুরক্ষা-বিধি পালন করেন, সেটা দলীয় নেতৃত্বকেই সুনিশ্চিত করতে হবে।’’ যদিও এক মাইক্রোবায়োলজিস্টের আক্ষেপ, ‘‘সাম্প্রতিক সময়ে এতগুলো সভা-মিছিল-সাংবাদিক বৈঠক হল এবং ক্রমাগত হয়ে চলেছে। কিন্তু সিংহভাগ নেতা-নেত্রীই মাস্ক পরা বা দূরত্ব-বিধি বজায় রাখার জন্য দলীয় কর্মী-অনুগামীদের কাছে আবেদন করছেন, তা দেখা গেল না!’’