দক্ষিণেশ্বর-সহ রাজ্যের প্রায় সব মন্দিরে ভক্ত নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। —ফাইল চিত্র
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে এ রাজ্যে নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সিনেমাহল, প্রেক্ষাগৃহ বা স্টেডিয়াম বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এড়িয়ে চলতে বলা হয়েছে বড়সড় জমায়েতও। এ রাজ্যের ধর্মীয়স্থানগুলিতে কিন্তু প্রতি দিনই বড়সড় জমায়েত হয়। সোমবারই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় করোনাভাইরাস মোকাবিলায় নবান্নে ডাকা বৈঠক শেষে রাজ্যে ‘মহামারি আইন’ লাগু করার কথা ঘোষণা করেন। সেই সঙ্গে সমস্ত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে অনুরোধও করেছিলেন, জমায়েত না করার জন্য ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু ধর্মীয়স্থানগুলির বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এখনও তেমন ভাবে কোনও কড়াকড়ি দেখা যায়নি।
ভিন্রাজ্যে ইতিমধ্যেই মহারাষ্ট্রে সিদ্ধি বিনায়ক মন্দির, শিরডির সাঁইবাবা মন্দির বা মুম্বাদেবীর মতো বড় মন্দিরগুলোয় মঙ্গলবার বিকেল থেকে ভক্ত এবং দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জানানো হয়েছে, এই নিষেধাজ্ঞা অনির্দিষ্ট কালের জন্যই। পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্তের কথা জানানো হবে। এ রাজ্যের কোনও ধর্মীয় স্থানে এখনও এ ধরনের কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
যদিও রবিবার বেলুড় মঠের পক্ষ থেকে দর্শনার্থীদের জন্য কিছু বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। যেমন, ভক্তেরা প্রেসিডেন্ট মহারাজকে দর্শন-প্রণাম করতে পারবেন না। সন্ধ্যারতিতে দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা হবে। এমনকি, ভোগ বিতরণ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়। একই পথে হেঁটে কামারপুকুর মঠ কর্তৃপক্ষও বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানিয়ে দেন, অনির্দিষ্ট কাল মঠে দুপুরের প্রসাদ বিতরণ বন্ধ থাকবে। ভক্তেরা দলবদ্ধ ভাবে মন্দিরে আসতে পারবেন না। একে একে প্রবেশ করে শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দিরে প্রণাম সারতে পারবেন। সন্ধ্যারতির সময় ভক্তেরা মন্দিরে বসতেও পারবেন না। ১৪ এপ্রিলের পর পরিস্থিতি অনুযায়ী পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
দক্ষিনেশ্বর মন্দির কর্তৃপক্ষও জানিয়েছেন, ভিড় যাতে কম হয় সে কারণে বিগ্রহ দর্শনের সময় কমাচ্ছেন তাঁরা। সেই সঙ্গে মন্দিরের নিরাপত্তাকর্মীদের নির্দেশ দেওয়া হয়, এক দর্শনার্থীর সঙ্গে যেন অন্য জনের ১ মিটারেরও বেশি ব্যবধান থাকে। তবে, এই পদ্ধতি কতটা কার্যকরী তা নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন তুলেছেন স্বাস্থ্যকর্তাদের একাংশ।
আরও পড়ুন: ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি, ঘরবন্দি থাকুন’, লকডাউন ঘোষণা এ বার ফ্রান্সে
কালীঘাট মন্দির কর্তৃপক্ষ কী ব্যবস্থা নিয়েছেন? এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হয় ওই মন্দিরের অছি পরিষদের সভাপতি শুভাশিস চক্রবর্তীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘‘আমরাও সতর্কতা মূলক ব্যবস্থা নিচ্ছি।” শুভাশিস জানিয়েছেন, কালীঘাট মন্দিরের গর্ভগৃহে সাধারণত ২৫-৩০ জন ঢুকতে পারে। এখন সেই সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। এ ছাড়া কোনও সতর্কতা নেওয়া হয়েছে কি না জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘‘ভোগ যাতে পরিচ্ছন্ন ভাবে রান্না হয়, সে ব্যাপারে নজর রাখা হচ্ছে।”
শুধু দক্ষিণেশ্বর বা কালীঘাট নয়, তারাপীঠের তারা মন্দিরে দর্শনার্থীদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে বলে জানা গিয়েছে বীরভূম জেলা প্রশাসন সূত্রে। মন্দিরের মধ্যে করোনা সচেতনতার প্রচার চালানো হচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রেও নিয়ন্ত্রণ আরও বেশি বলে মনে করছেন জেলার স্বাস্থ্য কর্তারা। এক স্বাস্থ্যকর্তা এই সতর্কতা প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘আরও কড়া ব্যবস্থা প্রয়োজন কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বর বা তারাপীঠ মন্দিরে। পুরোপুরি দর্শন বন্ধ না করেও, মন্দির কর্তৃপক্ষ সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দিতে পারেন।” পাশাপাশি ওই স্বাস্থ্য কর্তা অসমের গুয়াহাটির কামাখ্যা মন্দিরের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘‘ওখানে দর্শন বন্ধ না করেও অনেক কার্যকরী বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।’’
কামাখ্যা মন্দিরের দলই বা প্রধান কবীন্দ্র প্রসাদ শর্মা জানিয়েছেন, মঙ্গলবার থেকে মন্দিরে ঢোকা এবং বেরনোর পথে ভক্তদের হ্যান্ড স্যানিটাইজর দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি ভোগ বিতরণ বন্ধ রাখা হয়েছে। কারণ, ভোগ নিতে বড় জমায়েত হয়। মন্দির চত্বরে যেখানে ভক্তরা এক জায়গায় জমা হতে পারেন সেই জায়গাগুলো বন্ধ রাখা হচ্ছে। সেই সঙ্গে মন্দিরে হেল্প ডেস্ক রাখা হয়েছে দর্শনার্থীদের সাহায্য করতে।
হুগলির ব্যান্ডেল চার্চ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, দলবদ্ধ ভাবে পর্যটকদের ওই চার্চে ঢুকতে নিষেধ করা হয়েছে। অনেকে একসঙ্গে এলেও গেট থেকে ঢুকতে হবে প্রত্যেকের মধ্যে নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে। এত দিন প্রার্থনার আগে ‘পবিত্র’ জলে হাত ধুতে হত। এখন সেই জল রাখা বন্ধ করা হয়েছে। পর্যটকেরা যিশুর মূর্তি বা ক্রসে শুধু দূর থেকে প্রণাম জানাতে পারবেন। চার্চে ছড়িয়ে থাকা নানা মূর্তিতে হাত দিয়ে পর্যটকদের শ্রদ্ধা জানানোও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের পরে চার্চ বন্ধ হলে গোটা চত্বর জীবাণুনাশক ছড়িয়ে পরিষ্কার করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন: করোনা কাঁটা: শুরু হল ফেডারেশনের মিটিং, টালিগঞ্জের ভাগ্য নির্ধারণ আজ
তবে ওই জেলার তারকেশ্বরের ছবিটা একেবারেই অন্য রকম। মঙ্গলবারও সেখানে ভিড় দেখা গিয়েছে। সোমবার চিল থিকথিকে ভিড়। মন্দির কর্তৃপক্ষের তরফে কোনও সতর্কতা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। আগামী ১ এপ্রিল থেকে গাজনের মেলা শুরু হবে তারকেশ্বরে। প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ সেই মেলায় শামিল হন। প্রশ্ন উঠছে, সেই মেলার আয়োজন নিয়েও। তারকেশ্বরের পুরোহিতমণ্ডলীর এক সদস্য জানান, আগামী শুক্রবার এ বিষয়ে সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। মন্দিরের ব্যাপারে সে দিনই পরবর্তী কর্মসূচি চুড়ান্ত হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
অন্য দিকে, উত্তর ২৪ পরগনার ঠাকুরনগরে ইতিমধ্যে মতুয়া মেলা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বর্ধমানের কাটোয়ার অগ্রদ্বীপে শতাব্দী প্রাচীন গোপীনাথের মেলাও প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই মেলায় প্রায় সাড়ে তিন লাখ ভক্ত এবং দর্শনার্থীর ভিড় হয়। পূর্ব বর্ধমান জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, প্রথম দিকে মন্দিরের অছি পরিষদ মেলা বন্ধ রাখতে অসম্মত ছিল। তাদের যুক্তি ছিল, সমস্ত প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে। কিন্তু মঙ্গলবার কাটোয়া-২-এর ব্লক উন্নয়ন আধিকারিকের দফতরে প্রায় দেড় ঘণ্টার বৈঠকের পর মন্দিরের অছি পরিষদ মেলা বন্ধ রাখতে রাজি হয়। তবে চিরাচরিত ভাবে গোপীনাথের পুজো হবে। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মহকুমা শাসক প্রশান্তরাজ শুক্লা, বিডিও শমীক পাণিগ্রাহী-সহ প্রশাসনের বিভিন্ন কর্তারা।