করোনা সতর্কতা: মাস্ক পরে যাত্রীরা। কলকাতা বিমানবন্দরে। ছবি: পিটিআই।
রাজারহাটের চিত্তরঞ্জন ক্যানসার ইনস্টিটিউটে গড়া কোয়রান্টিনে গিয়ে রবিবার ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন বিদেশ থেকে কলকাতায় পা দেওয়া কয়েক জন যাত্রী। তাঁরা প্রশ্ন তোলেন, শরীরে করোনাভাইরাসের কোনও উপসর্গ না-থাকা সত্ত্বেও তাঁদের কোয়রান্টিন করে রাখা হচ্ছে কেন? এটা করাই বা হচ্ছে কোন আইনে?
তার পরেই সোমবার ১৮৯৭ সালের ‘দ্য এপিডেমিক ডিজ়িজ়েস অ্যাক্ট’ বা মহামারি রোগ আইন প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেয় রাজ্য সরকার। এর আগে প্রায় ১২টি রাজ্য এই আইন বলবৎ করেছে। কলকাতা বিমানবন্দর সূত্রের খবর, রবিবার রাত ১০টা থেকে সোমবার সকাল ১০টার মধ্যে বিদেশ থেকে শহরে নামা ২৪ জন নারী-পুরুষকে কোয়রান্টিনে পাঠানো হয়েছে। তাঁরা এসেছেন জার্মানি, ফ্রান্স বা স্পেন থেকে। তাঁদেরই কয়েক জন কোয়রান্টিনে বিক্ষোভ দেখান। তাঁদের মধ্যে কয়েক জন পড়ুয়া, কেউ কর্মসূত্রে বিদেশে থাকেন, কেউ গিয়েছিলেন বেড়াতে।
মহামারি রোগ আইন রূপায়ণের পাশাপাশি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে আপৎকালীন ছুটির মেয়াদ ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছে রাজ্য সরকার।
বিদেশিদের আপাতত ভারতে ঢোকা বারণ করে দেওয়া হয়েছে। এই অবস্থায় কলকাতায় কোয়রান্টিনে রাখা সকলেই আদতে ভারতীয় বলে কলকাতা বিমানবন্দর সূত্রের খবর। কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জার্মানি, ফ্রান্স বা স্পেন-সহ মোট সাতটি দেশ থেকে যাঁরা ভারতে ঢুকবেন, তাঁদের সকলকেই কোয়রান্টিনে রাখা হবে। স্বাস্থ্যপরীক্ষার পরে যদি দেখা যায় যে, কারও শরীরে কোনও উপসর্গ নেই, তাঁকে বাড়ি পাঠিয়ে আপাতত ‘গৃহবন্দি’ থাকার পরামর্শ দেওয়া হবে।
এক নজরে রাজ্যের মহামারি আইন
• করোনা-সন্দেহভাজন ভর্তি হতে না-চাইলে বলপূর্বক ভর্তি করানোর ক্ষমতা।
• সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা।
• রোগী করোনা-কবলিত দেশ থেকে এসে থাকলে রিপোর্ট করতেই হবে।
• করোনা রোধে জরুরি ভিত্তিতে স্বাস্থ্য দফতর এবং জেলাশাসকদের ওষুধ ও সামগ্রী কেনার ক্ষমতা।
• করোনা-পরীক্ষা একমাত্র সরকার স্বীকৃত ল্যাবরেটরিতেই।
• আক্রান্তের খবর মিললে করোনা রোধে স্থানীয় প্রশাসনের ক্ষমতা বৃদ্ধি।
এ রাজ্যে মহামারি রোগ আইন রূপায়ণের ব্যাখ্যা হিসেবে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, সঙ্কটের সময় চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী প্রত্যেককেই সহযোগিতা করতে হবে। প্রয়োজন হলে ১৪-২৮ দিন থাকতে হবে আইসোলেশনে। ‘‘যে-ভাবে আজ উত্তর ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসনকে হিমশিম খেতে হয়েছে, তার পরে আর ঝুঁকি নেওয়ার অবকাশ নেই। মহামারি রোগ আইন এ রাজ্যেও কার্যকর করছি। যাতে কেউ পরীক্ষার ভয়ে পালিয়ে যেতে না-পারে। আতঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। এটার অপপ্রয়োগ হবে না,’’ বলেন মুখ্যমন্ত্রী।
মহামারি রোগ আইনটি ব্রিটিশ আমলের। মূলত, প্লেগ, কলেরার মতো রোগে মহামারির মোকাবিলায় এই আইন প্রণয়ন করে ব্রিটিশরাজ। এর আওতায় সরকার সংশ্লিষ্ট পরিস্থিতির মোকাবিলায় কোনও ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টিকে আইন প্রণয়নের দায়িত্ব দিতে পারে। অর্থাৎ মহামারির মোকাবিলায় সাধারণ আইনে বলে দেওয়া কাজ নির্দিষ্ট ব্যক্তিরাই করতে পারেন। সরকার মনে করলে মহামারি রোগ আইনে যে-কোনও ব্যক্তিকে দিয়ে আইন রক্ষা, প্রশাসনিক পরিদর্শন এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার দিতে পারে। সেই অধিকার-বলে প্রয়োজন হলে স্বাস্থ্য আধিকারিকেরা কারও করোনার উপসর্গ আছে মনে করলে, তাঁকে বা কোনও করোনা সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে থাকা ব্যক্তিদের পৃথক পর্যবেক্ষণে রাখার অধিকার পাবেন। রোগ ছড়ানোর ক্ষেত্রে কোনও প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি দায়ী মনে হলে মহামারি রোগ আইনে সেই প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে হেফাজতে নেওয়ার অধিকারও দেওয়া হয়। কোনও নির্দিষ্ট স্থানকে মহামারি রোধে কাজে লাগানোর জন্য নির্দিষ্ট করতে পারে সরকার। তাতে বাধা দিলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আইন ভাঙছেন বলে ধরে নেওয়া হবে।
সোমবার নেপালে বেড়াতে যাওয়া এক দল পর্যটক কলকাতায় ফেরার পরে এলাকাবাসী তাঁদের পাড়ায় ঢুকতে বাধা দেন। পুলিশ তাঁদের বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে নিয়ে যায়। রাজারহাটের কোয়রান্টিনের বদলে এত বড় দলকে বেলেঘাটায় আনা হল কেন, সেই প্রশ্নও উঠছে। এখন বেলেঘাটায় আট জন ভর্তি আছেন। তাঁদের মধ্যে দু’জনের নমুনা দ্রুত পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। এক জন সম্প্রতি ফিনল্যান্ড, পর্তুগাল এবং জার্মানি গিয়েছিলেন। ওই সব দেশ থেকে ফেরার পরে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। অন্য এক জন বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা। তিনি ৮ থেকে ১৬ মার্চ তাইল্যান্ডে ছিলেন। কলকাতা বিমানবন্দরে নামার পরে তাঁকে আইডি-তে পাঠানো হয়। দু’জনের জ্বর-সর্দি, শ্বাসকষ্ট রয়েছে। বাকি পাঁচ জনের মধ্যে দু’জন কেরল এবং এক জন জাপান ও স্পেনের নাগরিকদের সংস্পর্শে আসায় পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। শ্রীলঙ্কার এক পাইলট ১৫ মার্চ কলকাতায় এসে জ্বর-কাশি নিয়ে ভর্তি হন আইডি-তে। আর দু’জনের ইনফ্লুয়েঞ্জা ধরা পড়েছে। এ ছাড়া সোয়াইন ফ্লু-তে আক্রান্ত পাঁচ জন এ দিন ভর্তি হয়েছেন আইডি-তে। করোনা সন্দেহে বিদেশ থেকে এসে যাঁরা পর্যবেক্ষণে আছেন, এ দিন তাঁদের সংখ্যা ১২ হাজার ছাড়িয়েছে।