কী ধরনের রোগ করোনা? এখানে কতটা প্রভাব ফেলবে? ইউরোপের মতোই কি? সাক্ষাৎকারে জানালেন অধ্যাপক কুণাল রায়, বিভাগীয় প্রধান, ফার্মাসিউটিক্যাল টেকনোলজি, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। সাক্ষাৎকার নিলেন ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়।
প্রশ্ন: সবার বোঝার জন্য প্রথমে একটু জেনে নেই— ঠিক কী ধরনের কাজ আপনাদের বিভাগ করে থাকে?
উত্তর: ধরুন কোনও ওষুধ, সেই ওষুধের সম্ভাব্য ডিজাইন, তার সংশ্লেষণ (Synthesis) প্রক্রিয়া, বিশ্লেষণ (Analysis)— এই সব কিছু নিয়ে আমাদের বিভাগ গবেষণা করায় এবং পড়ুয়াদের তা শেখায়। কোনও ওষুধের ফার্মাকোলজিক্যাল এবং বিষক্রিয়া সংক্রান্ত মূল্যায়ন নিয়েও আমরা কাজ করি।
প্রশ্ন: আপনারা কি করোনা ভাইরাস নিয়ে কাজ করেন বা করেছেন?
উত্তর: না, কাজ নিয়মিত করি, এমন নয়। কিন্তু এখন যে পরিস্থিতি, তার প্রেক্ষিতে কিছু পরিকল্পনা করেছি। কোভিড-১৯ সংক্রমণের টার্গেট মূলত কী কী, মানে শরীরের কোন কোন অংশে গিয়ে এরা বাসা বাঁধে, সে সম্পর্কে কিছু তথ্য রয়েছে। মানে অনেক টার্গেটই চিহ্নিত হয়ে গিয়েছে। সে সব তথ্যের ভিত্তিতে আমরা এই ভাইরাসের গতিপ্রকৃতি এবং কার্যকলাপ বোঝার চেষ্টা করছি। আমরা কম্পিউটেশনাল মডেলিংটাও করছি।
প্রশ্ন: আচ্ছা, করোনাকে কি এক ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা বলা যায়?
উত্তর: হ্যাঁ। দুটো ক্ষেত্রেই উপসর্গের মিল রয়েছে, শ্বাসকষ্ট হয়। তবে শ্বাসকষ্টের প্রাবল্য আলাদা আলাদা। আর শরীরে ভাইরাস ঢোকা এবং অসুস্থ হয়ে পড়ার মাঝে যে সময়টা (মেডিয়ান ইনকিউবেশন পিরিয়ড), তার ক্ষেত্রেও ফারাক রয়েছে।
আরও পড়ুন: হাসপাতালের ডায়েরি: অক্সফোর্ড থেকে ফিরে
প্রশ্ন: আমাদের এখানে ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রকোপ বোধ হয় খুব একটা নেই?
উত্তর: না না, এটা ঠিক নয়। প্রকোপ রয়েছে। এই করোনা ভাইরাস নিয়ে গোটা পৃথিবী এখন কাঁপছে ঠিকই। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, ২০১৭, ২০১৮ বা ২০১৯ সালে ভারতে সোয়াইন ফ্লু কিন্তু সাংঘাতিক প্রভাব ফেলেছিল।
প্রশ্ন: তা হলে এটা কি বলা যায় যে, এখানকার পরিবেশ ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের পক্ষে খুব একটা সহায়ক নয়?
উত্তর: দেখুন, ভারত হল ক্রান্তীয় অঞ্চল বা ক্রান্তীয় আবহাওয়ার দেশ। এই দেশের বেশির ভাগ এলাকায় তাপমাত্রা কেমন থাকে? বছরের বেশিটা জুড়েই তাপমাত্রা থাকে উষ্ণ থেকে তপ্তের মধ্যে। মানে দেশের অধিকাংশ এলাকাতেই খুব ঠান্ডা থাকে না। সুতরাং পরিবেশটা বা আবহাওয়াটা একটা ফ্যাক্টর তো বটেই।
প্রশ্ন: অর্থাৎ আমাদের এখানে সাধারণত ইনফ্লুয়েঞ্জার একটা দুর্বল সংস্করণ হানা দেয়?
উত্তর: বলা যেতে পারে। কিন্তু ১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লু এবং ১৯৫৭ সালে এশিয়ান ফ্লু ভারতে কিন্তু যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল।
প্রশ্ন: কিন্তু সেই স্প্যানিশ ফ্লু-ও তো বাংলাকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। এমনকি করোনার ক্ষেত্রেও দেখুন, করোনা অনেকের হচ্ছে, কিন্তু সাঙ্ঘাতিক ভাবে চেপে বসছে না। করোনার জন্য ভেন্টিলেশনে পাঠাতে হচ্ছে, এই রকম রোগীর সংখ্যা কিন্তু এখানে নগণ্য। তাই না?
উত্তর: এখনই এ রকম উপসংহারে পৌঁছতে পারব না। এর জন্য আরও অনেক তথ্যের বিশ্লেষণ দরকার।
প্রশ্ন: আচ্ছা, একটা কথা বলুন। কোনও রোগের এই মৃদু আক্রমণ কি খারাপ? এর ফলে আসলে রোগের বিরুদ্ধে একটা সামাজিক প্রতিরোধ ক্ষমতা (Herd Immunity) তৈরি হয়ে যায় না কি?
উত্তর: এর উত্তরও এই রকম সরলীকৃত ভাবে দিতে পারব না। সামাজিক প্রতিরোধ ক্ষমতা (Herd Immunity) তৈরি হচ্ছে কি না, সেটাও গবেষণার বিষয়।
প্রশ্ন: কোনও কোনও গবেষক বলছেন, ভারতের করোনা ব্রিটেনের করোনার মতো অত শক্তিশালী নয়। সেই কারণেই নাকি সঙ্কটজনক পরিস্থিতি কম তৈরি হচ্ছে বা মৃত্যুর অনুপাত কম?
উত্তর: হ্যাঁ, পরিবেশ সংক্রান্ত ফ্যাক্টর এবং জিনগত ফারাক তো কিছুটা পার্থক্য তৈরি করে দেয়ই।
আরও পড়ুন: নিজামউদ্দিনে যোগ দেওয়া ৬৪৭ জনের করোনা পজিটিভ, জানাল কেন্দ্র
প্রশ্ন: এ রকম বলা হচ্ছে যে, বাইরে থেকে আসা এই ভাইরাসটা কোনও শরীরে ঢুকে সেখানে নিজের প্রতিরূপ তৈরি করতে থাকে। সেই প্রক্রিয়ার সময়ে এই ভাইরাসটা নিজেকে পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে চায়। খাপ খাইয়ে নিতে চায়, কারণ ডারউইনের তত্ত্বকে অনুসরণ করে। নিজের প্রজাতিকে এরা টিকিয়ে রাখতে চায়, সেটাই মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠে। আর টিকিয়ে রাখতে চায় বলেই পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। এবং সেই চেষ্টাটার সময়েই এরা ক্রমশ কম আগ্রাসী হয়ে পড়ে, কারণ পরিবেশ প্রতিকূল থাকে। এই তত্ত্ব কি ঠিক?
উত্তর: দেখুন, পরিবেশের তাপমাত্রা যদি খুব বেশি থাকে এবং আবহাওয়া যদি রৌদ্রোজ্জ্বল হয়, তা হলে যে কোনও ধরনের জীবাণুর পক্ষেই সংক্রামিত হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
প্রশ্ন: কয়েক জন গবেষক বলছেন, ভারতীয়দের জিনোমে একটা নির্দিষ্ট আরএনএ রয়েছে, যেটার সঙ্গে লড়া এই ভাইরাসের পক্ষে খুব কঠিন হয়।
উত্তর: বিভিন্ন জাতির মধ্যে জিনের ফারাক তো থাকেই। তার একটা ভূমিকাও এ ক্ষেত্রে থাকবেই।
প্রশ্ন: বিদেশে এই রোগ যে ভাবে ছড়াচ্ছে এবং ভারতে যে ভাবে ছড়াচ্ছে, তার ফারাকটা নিয়ে কিছু বলবেন?
উত্তর: হ্যাঁ, সংক্রমণের প্রাবল্যে তো ফারাক রয়েছেই। সেটা অবশ্যই পরিবেশগত কারণে এবং জিনের ফারাকের কারণে।
প্রশ্ন: এই রোগটা শ্বেতাঙ্গদের রোগ— এ রকম বলতে পারব?
উত্তর: এখনই এটা বলার সময় আসেনি। ভারতে এই রোগটা ঠিক কতটা প্রভাব ফেলল, কী রকম প্রভাব ফেলল, সে সব তথ্য আগে আসতে দিন।
প্রশ্ন: আইসিজিইবি দিল্লির এক জন এই নিয়ে একটা পেপার লিখেছেন— দীনেশ গুপ্ত। তাতে এই রকম ইঙ্গিত রয়েছে।
উত্তর: ও, আচ্ছা।