দেশের ১০টিরও বেশি রাজ্য থেকে লোকজন গিয়েছিলেন নিজামউদ্দিনের ধর্মীয় সভায় যোগ দিতে। প্রতীকী ছবি।
দিল্লির নিজামউদ্দিনের ধর্মীয় সভা চিন্তা বাড়াল এ রাজ্যেরও। নিজামউদ্দিনের সভায় যোগ দেওয়া তেলঙ্গানার অন্তত ৬ বাসিন্দা করোনা-আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন। জানা গিয়েছে, এ রাজ্যেরও কয়েকশো মানুষ গিয়েছিলেন দিল্লির ওই সভায় যোগ দিতে। তাঁদের একটি অংশ ইতিমধ্যে ফিরেও এসেছেন বাংলায়। আর সেটাই রাজ্য প্রশাসনের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখছে তারা।
রাজ্য সরকার ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গ থেকে ওই ধর্মীয় সভায় যাওয়া ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার কাজ শুরু করেছে। মঙ্গলবার রাজ্যের স্বরাষ্ট্র সচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় টুইট করে জানিয়েছেন, ‘‘এ রাজ্য থেকে দিল্লির তবলিগ জামাতে যাওয়া প্রত্যেককে চিহ্নিত করার কাজ শুরু হয়েছে। তাঁদের প্রত্যেকের করোনা পরীক্ষার পাশাপাশি ১৪ দিনের জন্য বাধ্যতামূলক কোয়রান্টিনে পাঠানো হবে।’’
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রে জানানো হয়েছে, তাদের তরফে প্রাথমিক একটি তালিকা ইতিমধ্যেই বিভিন্ন রাজ্যকে পাঠানো হয়েছে। দেশের ১০টিরও বেশি রাজ্য থেকে লোকজন গিয়েছিলেন ওই ধর্মীয় সভায় যোগ দিতে। কেরল, তামিলনাড়ু, তেলঙ্গনার মতো দক্ষিণের রাজ্যের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ ও অসম থেকেও প্রচুর মানুষ গিয়েছিলেন ওই তবলিগ জামাতে। বাংলাদেশ থেকেও অনেকে যোগ দিয়েছিলেন দিল্লির ওই সভায়। তাঁদের অনেকে আবার যাতায়াতের পথ হিসেবে ব্যবহার করেছেন কলকাতাকে। রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘‘স্বাস্থ্য দফতর গোটা বিষয় নিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখছে।”
আরও পড়ুন: নতুন করে নিজামউদ্দিনের ৩৫ জন আক্রান্ত, বাড়ছে উদ্বেগ
স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘এটা প্রমাণিত যে, ওই ধর্মসভায় যাঁরা গিয়েছিলেন তাঁদের অনেকেই কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন। ওই আক্রান্তদের সংস্পর্শে এসেছেন অনেকেই। তার মধ্যে এ রাজ্যের মানুষও ছিলেন। আর তাঁরা যদি ইতিমধ্যে ফিরে এসে থাকেন এবং সবার সঙ্গে মেলামেশা করা শুরু করেন, সেটা কিন্তু বড় বিপদ ডেকে আনবে।”
স্বাস্থ্য কর্তাদের যুক্তি, সব সময় করোনা-সংক্রমণের উপসর্গ সঙ্গে সঙ্গেই প্রকাশ পাবে এমন না-ও হতে পারে। এমনকি যিনি করোনা-আক্রান্তের সংস্পর্শে এসেছেন, তিনি আক্রান্ত না-ও হতে পারেন। তাঁর শরীর থেকে অন্য কারও শরীরে সংক্রমণ ছড়াতে পারে। তাই দ্রুত ধর্মসভায় যোগ দেওয়া ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা প্রয়োজন। এক স্বাস্থ্যকর্তার কথায়, ‘‘এই চিহ্নিতকরণ করতেই হবে। ঠিক যেমন ভাবে তামিলনাড়ু এবং অসম করছে।’’
আরও পড়ুন: দিল্লির মসজিদে জমায়েত, কোয়রান্টিনে পাঠানো হল ২০০০ জনকে
আরও পড়ুন: মনোবল বাড়াতে পরিযায়ী শ্রমিকদের কাউন্সেলিংয়ের নির্দেশ সুপ্রিম কোর্টের
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বাংলাদেশ-সহ বিভিন্ন দেশের ধর্মপ্রচারকরা দিল্লির ধর্মসভা শেষ করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়েছেন। তাঁদের কেউ এ রাজ্যে এসেছেন কি না তা এখনও স্পষ্ট নয়। রাজ্য সরকারের তরফে এখনও সরকারি ভাবে ওই ধর্মীয়সভায় এ রাজ্য থেকে যোগদানকারীদের সংখ্যা প্রকাশ করা হয়নি। রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষ কর্তা জানিয়েছে, প্রাথমিক ভাবে ৭৩ জনের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এই সংখ্যা অনেকটাই বাড়তে পারে বলে তাঁর ইঙ্গিত। ওই পুলিশ কর্তার দাবি, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, উত্তর ২৪ পরগনার বেশ কয়েক জন দিল্লির ধর্মীয় সভায় যোগ দিতে গিয়েছিলেন বলে প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছে। রাজ্যের বেশ কিছু থানাকে তাদের এলাকায় খোঁজ নিতে বলা হয়েছে। যোগাযোগ করা হচ্ছে ধর্মীয় সংগঠনগুলির সঙ্গেও, যারা এই তবলিগ যাত্রার আয়োজন করে।
আরও পড়ুন: অসমে মৃত ডাক্তার, করোনা ঠেকাতে ম্যালেরিয়ার ওষুধ খেয়েই কি?
অসম সরকারের তরফে জানানো হয়েছে, এখনও পর্যন্ত সে রাজ্যে প্রায় ৩০০ জনের হদিশ পাওয়া গিয়েছে, যাঁরা ওই ধর্মীয় সভায় যোগ দিতে গিয়েছিলেন। উত্তরপ্রদেশও প্রায় ১৬০ জনের একটি তালিকা ইতিমধ্যেই তৈরি করেছে।
চলতি মাসের ১৩ থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত দিল্লির নিজামউদ্দিনে আলামি মাশোয়ারা নামে একটি ধর্মীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় ১ বছর আগে থেকে ওই ধর্মীয় সভা বা মরকজের দিন ক্ষণ নির্দিষ্ট ছিল। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত এবং বিদেশ থেকে প্রায় আড়াই হাজার মানুষ জমায়েত হয়েছিলেন ওই তবলিগে। শুধু বিদেশ থেকেই ধর্মপ্রচারের ওই সভায় এসেছিলেন প্রায় ২৫০ জন। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপিন্স, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা থেকে ওই প্রচারকরা এসেছিলেন বলে দিল্লি পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে।
নিজামউদ্দিনের ওই তবলিগের সদর দফতর বাঙলাওয়ালে মরকজের এক মুখপত্র মহম্মদ ইউসুফ বলেন, ‘‘মরকজের সাত তলা বাড়িতে প্রায় আড়াই হাজার মানুষ ছিলেন।” তাঁর দাবি, ওই সভা সরকারি সমস্ত আইন মেনেই হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে গত ২২ মার্চ, রবিবার ‘জনতা কার্ফু’ও তাঁরা পালন করেছেন। ওই রবিবারের আগে এবং পরের দিন অর্থাৎ সোমবার সকালে প্রায় হাজার জন নিজেদের গন্তব্যে রওনা হয়ে যান বলে দাবি করেন ইউসুফ। কিন্তু ২৪ মার্চ, মঙ্গলবার রাতেই দেশ জুড়ে লকডাউন ঘোষণা শুরু করেন প্রধানমন্ত্রী। ইউসুফের দাবি, এই এর আটকে পড়েন সভায় যোগ দেওয়া অনেকেই। সংগঠনের তরফে দাবি করা হয়েছে, তারা আগাগোড়া স্থানীয় হজরত নিজামউদ্দিন থানার সঙ্গে যোগাযোগ করে চলেছেন।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের প্রতিনিধি দল, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র চিকিৎসক এবং প্রতিনিধিরা ওই ধর্মসভায় যোগদানকারীরা বাঙলাওয়ালে মরকজের যেখানে রয়েছেন সেই জায়গা পরিদর্শন করেছেন। অন্তত ৩০০ জনকে ইতিমধ্যেই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে, বিদেশ থেকে আসা ধর্মপ্রচারকদের থেকেই কোভিড-১৯ ছড়িয়েছে সেখানে। ওই ধর্মীয় সভায় যোগ দেওয়া ফিলিপিন্সের নাগরিক এক ধর্মপ্রচারকের মৃত্যু হয়েছে মুম্বইতে।
সাহাবুদ্দিন আহমেদ নীরব নামে বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার এক বাসিন্দা সোশ্যাল মিডিয়ায় জানিয়েছেন, সে দেশের অনেকেই ওই ধর্মীয় সভায় যোগ দিয়েছেন। তাঁদের অনেকেই ভারতে আটকে পড়ে কলকাতার একটি মরকজ (যাঁরা তবলিগ যাত্রা আয়োজন করেন)-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। এ দিন সকালে ‘বিডি গ্রুপ নিজামউদ্দিন’ নামে এক সোশ্যাল মিডিয়া গ্রুপে একটি ভিডিয়ো প্রকাশ করা হয়েছে। দিল্লির ধর্মসভায় যোগ দেওয়া বাংলাদেশিরাই ওই গ্রুপের সদস্য। সেই ভিডিয়োতে বাঙলাওয়ালে মরকজের ছবি রয়েছে। ভিডিয়োর ছবি দেখিয়ে সেখানে দাবি করা হয়েছে, কলকাতা-সহ পশ্চিমবঙ্গের অনেকে এখনও রয়েছেন দিল্লিতে, তবলিগের সদর দফতর বাঙলাওয়ালে মরকজে।
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)