ফাইল চিত্র।
সংখ্যাধিক্যই শুধু নয়, কলকাতা-সহ এ রাজ্যের করোনাভাইরাসের নমুনায় নতুন মিউটেশনেরও সন্ধান পেল ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োমেডিক্যাল জিনোমিক্স’ (এনআইবিএমজি) এবং আইসিএমআর-নাইসেডের গবেষণা। একই সঙ্গে গবেষকেরা জানিয়েছেন, ইউরোপ-যোগ থেকেই এ রাজ্যে নোভেল করোনাভাইরাসের এমন বাড়বাড়ন্ত।
কেন্দ্রীয় গবেষণা সংস্থা আইসিএমআর এবং নাইসেডের সহযোগিতায় এ রাজ্যে নোভেল করোনাভাইরাসের গতিবিধি নিয়ে গবেষণা করছে কল্যাণীর এনআইবিএমজি। কেন্দ্রীয় ওই গবেষণা সংস্থার ডিরেক্টর তথা ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স’-এর অধ্যাপক সৌমিত্র দাসের তত্ত্বাবধানে কলকাতা-সহ এ রাজ্যে ভাইরাসের সিকোয়েন্স করেছেন এনআইবিএমজি-র গবেষক
অরিন্দম মৈত্র।
নাইসেডের সহযোগিতায় কলকাতা, হাওড়া, পূর্ব মেদিনীপুর, নদিয়া এবং দার্জিলিঙের কোভিড আক্রান্তদের নমুনা থেকে ভাইরাসের ওই সিকোয়েন্স করা হয়েছে।
অরিন্দম বলেন, ‘‘ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ভাইরাসের যে স্ট্রেন দেখা গিয়েছে, তা-ই মূলত আমাদের রাজ্যে এসেছে।’’ আক্রান্তদের সংস্পর্শ যোগ ও ভ্রমণ বৃত্তান্ত পর্যালোচনা
করেও ইউরোপ যোগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে মত তাঁর।
সারা বিশ্বে করোনার যে ‘টাইপ’-এর দাপট সব চেয়ে বেশি, তা হল, ‘এ২এ’। এ রাজ্যেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। তবে এক জনের নমুনায় ‘বি৪’ ক্লেডের কোভিড মিলেছে বলে জানিয়েছেন এনআইবিএমজি-র গবেষক। তাঁর কথায়, ‘‘সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসের যত সিকোয়েন্স নথিভুক্ত হয়েছে, তার মধ্যে ‘বি৪’-এর সংখ্যা এক শতাংশেরও কম। চিন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মূলত এই ধরনের ভাইরাস দেখা গিয়েছে।’’
ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল সম্পর্কে আলোকপাত করার পাশাপাশি এই গবেষণার আরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক রয়েছে। এ রাজ্যে অল্প সময়ের মধ্যে কোভিডের মিউটেশনের সংখ্যা যে অনেক বেশি, তা আগেই জানিয়েছিলেন নাইসেড-প্রধান শান্তা দত্ত। শনিবার এনআইবিএমজি-র ডিরেক্টর জানান, গবেষণায় ‘নিউক্লিওক্যাপসিড’ এবং ‘আরএনএ ডিপেন্ডেন্ট আরএনএ পলিমারিজ’ প্রোটিনের মিউটেশনের মধ্যে বেশ কিছু নতুন মিউটেশনের সন্ধান মিলেছে। ‘নিউক্লিওক্যাপসিড’ প্রোটিনে নতুন যে মিউটেশন মিলেছে, তার নাম ‘জি২০৪আর’। ‘আরএনএ ডিপেন্ডেন্ট আরএনএ পলিমারিজ’ প্রোটিনের নতুন মিউটেশনটি হল, ‘পি৩২৩এল’। ইতিমধ্যে এ বিষয়ে গবেষণাপত্র ‘জার্নাল অব বায়োসায়েন্সেস’-এ প্রকাশিত হওয়ার জন্য গৃহীত হয়েছে।
এই নতুন আবিষ্কারের তাৎপর্য ব্যাখ্যায় গবেষক অরিন্দম জানান, ভাইরাসের গঠনে ‘নিউক্লিওক্যাপসিড’-এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রোটিন ত্রুটিপূর্ণ হলে ভাইরাস গঠনই হবে না। ‘আরএনএ ডিপেন্ডেন্ট আরএনএ পলিমারিজ’ (আরডিআরপি) ভাইরাস কপি করে। তাই ‘নিউক্লিওক্যাপসিড’ এবং ‘আরডিআরপি’র মধ্যে নতুন মিউটেশনের সন্ধান কোভিডের গঠনমূলক পরিবর্তনেরও ইঙ্গিতবাহী।
ভাইরাসের প্রবেশে মানবদেহে প্রোটিনের গঠনগত পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা করছেন অন্য দুই বিজ্ঞানী। বস্তুত, এনআইবিএমজি-র পাশাপাশি কোভিড নিয়ে এই গবেষণায় সারা দেশের সব ক’টি বায়োটেকনোলজি ইনস্টিটিউটের ভূমিকা রয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে এনআইবিএমজি-র ডিরেক্টর পদে কর্মরত ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স’-এর গবেষক সৌমিত্রবাবু জানালেন, করোনাভাইরাসের জন্য মাইক্রো আরএনএ-তে কী ধরনের পরিবর্তন হচ্ছে, তা নিয়ে কাজ করেছেন ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স’-এর গবেষক হর্ষ রাহেজা। আবার স্পাইক প্রোটিনের মিউটেশন ‘ডি৬১৪জি’-র গঠনগত দিক নিয়ে গবেষণা করছেন এন শ্রীনিবাসন।
এনআইবিএমজি-র গবেষক অরিন্দম বলেন, ‘‘আমাদের দেহে অনেক রকমের মাইক্রো আরএনএ রয়েছে। সংক্রমণের শিকার হলেও কিছু মাইক্রো আরএনএ রয়েছে, যারা ভাইরাসের বংশবৃদ্ধি রোধ করে। নিউক্লিওক্যাপসিডের ক্ষেত্রে যে সব মাইক্রো আরএনএ-কে বংশবৃদ্ধি রোধের সহায়ক ভাবা হয়েছিল, তারা সে কাজ করতে পারছে না। ফলে সংক্রমণের মাত্রা বাড়ছে।’’ কো-মর্বিডিটির ক্ষেত্রে কেন এই ভাইরাস মারাত্মক হয়ে উঠছে, মাইক্রো আরএনএ-র ভূমিকা থেকে তারও আভাস মিলেছে। নোভেল মিউটেশনগুলি নিয়ে বিশদে গবেষণা করলে আরও বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর মিলবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
সৌমিত্রবাবু জানান, আগামী দিনে দেশ জুড়ে এক হাজার ভাইরাস সিকোয়েন্স নিয়ে কাজ হবে। তাঁর কথায়, ‘‘গুজরাত, দিল্লি, কলকাতা বা মহারাষ্ট্রে ভাইরাসের যে সব টাইপ রয়েছে, তাদের মধ্যে কী তফাত আমরা দেখতে চাইছি? ভাইরাসের টাইপগুলির মধ্যে কোনও যোগসূত্র রয়েছে কি না, বিভিন্ন রাজ্যের ভাইরাসের মিউটেশনের পিছনে দায়ী কে, সে সবও গবেষণার বিষয়।’’