শিক্ষক শিবিরের অনেকে আপত্তি তুলেছিলেন উৎসশ্রীর মাধ্যমে বদলি নীতি চালু করার উদ্যোগ পর্বেই। প্রতীকী ছবি।
স্কুল স্তরে বদলি নিয়ে বহু বছরের অনুযোগ-অভিযোগের প্রযুক্তিগত মোকাবিলার লক্ষ্যেই যাকে গড়ে তোলা হয়েছিল, সেই ‘উৎসশ্রী’ পোর্টালের নামোচ্চারণ মাত্রই এখন কার্যত মুখে কুলুপ আঁটছেন শিক্ষা দফতরের কর্তারা। কারণ, গ্রাম-মফস্সলের স্কুলে শিক্ষক-ঘাটতি এবং তার সুরাহায় কলকাতা থেকে গ্রামে শিক্ষক বদলির সাম্প্রতিক উদ্যোগের জন্য ‘যত দোষ, উৎসশ্রী ঘোষ’ বলেই রব উঠেছে। শিক্ষা দফতরের কর্তারাও সেটা উড়িয়ে দিতে পারছেন না। কোনও কোনও শিক্ষক সংগঠনের তরফে উৎসশ্রীর মাধ্যমে বদলির ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ তুলতেও কসুর করছে না। সব মিলিয়ে বহুমুখী তিরের মুখে উৎসশ্রী।
শিক্ষক শিবিরের অনেকে আপত্তি তুলেছিলেন উৎসশ্রীর মাধ্যমে বদলি নীতি চালু করার উদ্যোগ পর্বেই। এই প্রযুক্তিনির্ভর পদ্ধতিতে লাগামছাড়া বদলির জেরে গ্রামীণ স্কুলগুলি যে অচিরেই শিক্ষকের অভাবে ধুঁকতে শুরু করবে, সে-কথাও বলেছিলেন তাঁরা। সরকার এখন শিক্ষক-ঘাটতি মেটাতে শহর থেকে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দলে দলে গ্রামে পাঠানো শুরু করেছে এবং তাতে নানান বিশৃঙ্খলা, অনিয়মের অভিযোগও উঠছে। এই পরিস্থিতিতে ফের উৎসশ্রী পোর্টাল মারফত বদলিকেই কাঠগড়ায় তুলছে শিক্ষক সংগঠনগুলি।
উৎসশ্রী পোর্টালে বদলির জন্যই যে এখন প্রবল শিক্ষক-ঘাটতি তৈরি হয়েছে, শিক্ষা দফতরের কর্তারাও তা অস্বীকার করতে পারছেন না। সেই জন্যই ‘উৎসশ্রী’ শব্দটি কানে গেলেই মৌন অবলম্বন করছেন তাঁরা। যদিও এই মুহূর্তে ওই পোর্টালের মাধ্যমে শিক্ষকদের বদলি বন্ধ আছে।
এক ধাপ এগিয়ে এবিটিএ বা নিখিল বঙ্গ শিক্ষক সমিতির অভিযোগ, উৎসশ্রী মারফত বদলিতে টাকার লেনদেন হয়েছে এবং খাটানো হয়েছে রাজনৈতিক প্রভাবও। তার ফলে গ্রামীণ এলাকার স্কুলগুলিতে শিক্ষার্থী-শিক্ষক অনুপাত তলানিতে ঠেকেছে। এখন ছাত্রছাত্রীর সংখ্যার সঙ্গে মিলিয়ে শিক্ষকের অনুপাত স্থির করতে গিয়ে ঘাটতি-উদ্বৃত্তের হিসেব দেখানো হচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে সেই হিসেব নিয়েও। এক শিক্ষক-নেতা বলেন, ‘‘উৎসশ্রীর মাধ্যমে বদলির সময় কোনও অনুপাতের হিসেব কেন করা হয়নি, বদলির পিছনে টাকা লেনদেন কাজ করেছে কি না— এই সব প্রশ্ন তো উঠবেই।’’ শিক্ষা দফতরের খবর, উৎসশ্রী মারফত বদলিতে গ্রাম থেকে শহরে আসার ঝোঁক ছিল বেশি। সেই ব্যবস্থায় শহর থেকে গ্রামে ফিরেছেন মুষ্টিমেয় শিক্ষক-শিক্ষিকা।
এবিটিএ-সহ শিক্ষক সংগঠনগুলির আরও অভিযোগ, উৎসশ্রীর ফলে সৃষ্ট ঘাটতি মেটানোর জন্য নতুন শিক্ষক নিয়োগ জরুরি ছিল। কিন্তু গত বারের নিয়োগ ঘিরেই দুর্নীতির বিস্তর কালিঝুলি লেগেছে সরকারের গায়ে। নতুন নিয়োগ হয়নি। অভিযোগ উঠছে, এখন নতুন বদলি নীতির মাধ্যমে আগামী নিয়োগের রাস্তাও বন্ধ করে দিতে চাইছে সরকার। তার ফলে বেকারত্ব আরও বাড়বে অচিরেই।
অ্যাডভান্সড সোসাইটি ফর হেডমাস্টার্স অ্যান্ড হেডমিস্ট্রেসের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক চন্দন মাইতি বলেন, ‘‘কয়েকশো শিক্ষককে বদলি করে হাজার হাজার শূন্য পদ পূরণ করা যায় না। অবিলম্বে শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগ করা জরুরি। তবেই মূল সমস্যার সমাধান করা যাবে।’’ শিক্ষানুরাগী ঐক্য মঞ্চের রাজ্য সম্পাদক কিঙ্কর অধিকারী বলেন, ‘‘দীর্ঘ কাল নিয়োগ না-হওয়ায় সমস্যা তৈরি হয়েছে। আর এই বদলি নীতির মাধ্যমে ভারসাম্য রক্ষা করা যাচ্ছে বলে দেখানোর চেষ্টা চলছে।’’
তবে পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি রাজ্য সভাপতি দিব্যেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘শিক্ষক নিয়োগের সঙ্গে বদলির কোনও সম্পর্ক নেই। আদালতের নির্দেশে এই বদলি হচ্ছে। স্কুলে ৪০ জন পড়ুয়া-পিছু এক জন শিক্ষক, এই লক্ষ্য রেখেই এই বদলি প্রক্রিয়া চলছে।’’