এক রাতের মধ্যেই অভিভাবকহীন হয়ে পড়ল একটা সরকারি প্রতিষ্ঠান।
সবে শুরু করেছিল। সাবালক হয়েছে কি না, তার চূড়ান্ত প্রমাণ মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়াকে দেওয়ার জন্য সময় আর মাত্র এক বছর। বিপুল কাজ বকেয়া। সেই কাজ শেষ হওয়ার উপরে নির্ভর করছে ফি বছর ভর্তি হওয়া ১০০ জন করে পড়ুয়ার ভবিষ্যৎ। ঠিক এমন একটা সন্ধিক্ষণে অভিভাবকহীন হয়ে পড়ল সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। আর তার ফলে তাদের ভবিষ্যৎই পড়ে গেল প্রশ্নচিহ্নের মুখে।
কবে নতুন অধ্যক্ষ আসবেন, তা কেউ জানেন না। চরম অনিশ্চয়তায় ছাত্র, শিক্ষক, অশিক্ষক কর্মচারীরা। এক অধ্যাপক জানালেন, অন্য পাঁচটা কলেজের সঙ্গে সাগর দত্তকে গুলিয়ে ফেললে হবে না। এই কলেজের মাথায় খাঁড়া ঝুলছে। আগামী বছরের মধ্যে পরিকাঠামোগত শর্ত পূরণ না-করলে কলেজের অনুমোদন বাতিল হয়ে যাবে। টাকা পেতে প্রতিটি ফাইলেই অধ্যক্ষকে সই করতে হবে। এই সময় কলেজটি অকূল পাথারে পড়ে গেল।
এত দিন যিনি অভিভাবক ছিলেন, অধ্যক্ষ সেই দেবাশিস ভট্টাচার্য বুধবারই নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দিয়েছেন। স্বাস্থ্য ভবন নতুন অধ্যক্ষ করে পাঠিয়েছিল এসএসকেএম হাসপাতালের অধিকর্তা প্রদীপ মিত্রকে। কিন্তু প্রদীপবাবু ওই পদে যোগ না দিয়ে এ দিনই স্বেচ্ছাবসরের চিঠিটি জমা দিয়েছেন স্বাস্থ্য ভবনে।
কলেজ সূত্রের খবর, আট কোটি টাকার সরঞ্জাম কেনার কথা ছিল ক’দিনের মধ্যে। সেই সরঞ্জামে সেজে ওঠার কথা হাসপাতালের ১১টি নতুন অপারেশন থিয়েটার। যত দিন না নতুন অধ্যক্ষ আসছেন তত দিনের মতো প্রক্রিয়াটি থমকে গেল। লাইব্রেরিতে তিন হাজার নতুন বই কেনার কাজও অসমাপ্ত। অ্যাকাডেমিক ভবনে আসবাব কেনার কাজও শিকেয়।
২০১৬-তে এমসিআই-এর কাছ থেকে চূড়ান্ত ছাড়পত্র পাওয়ার কথা। তারও কিছু নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া রয়েছে, যেটা করতে পারেন একমাত্র অধ্যক্ষই। এখন কে করবেন কেউ জানে না। এক শিক্ষকের আক্ষেপ, ‘‘অনুমোদন নিয়ে বারবার ধাক্কা খেয়ে প্রতিষ্ঠানটি সবে একটু ধাতস্থ হয়েছে, ফের অনিশ্চয়তা!’’
কলেজের শিক্ষক-চিকিৎসকদের বক্তব্য, ‘‘দেবাশিসবাবু সমস্যাগুলি জানতেন। উদ্যোগী হয়ে সব কাজ করছিলেন। নতুন কেউ কাজে যোগ দিলে বিষয়টা বুঝতেই কয়েক মাস কেটে যাবে। এখন প্রতিটি দিনই গুরুত্বপূর্ণ। ফের পিছিয়ে গেলাম।’’
এই অনিশ্চয়তাকে কেন্দ্র করে দানা বাঁধছে অভিমানও। হাসপাতালের শিক্ষক-চিকিৎসক, নার্স, অন্যান্য কর্মী থেকে শুরু করে পড়ুয়াদের একটা বড় অংশই প্রশ্ন তুলেছেন— কেন এলেন না প্রদীপবাবু? কেন সাগর দত্তে যোগ দেওয়াকে তাঁর পদাবনতি বলে মনে হল? রেডিওলজি বিভাগের প্রধান রেজাউল করিম বলেন, ‘‘কোনও না কোনও সময়ে সব প্রতিষ্ঠানই তো পথ চলা শুরু করে। তখন যদি কেউ এসে হাত না-ধরে তা হলে সেই প্রতিষ্ঠানই বা দাঁড়াবে কী করে?’’ একই কথা বলেছেন মেডিসিন, সার্জারি, স্ত্রীরোগ বিভাগের একাধিক চিকিৎসক। তাঁদের বক্তব্য, নিওনেটোলজি বিভাগ না থাকা সত্ত্বেও যখন অরুণ সিংহকে এসএসকেএম থেকে সাগর দত্তে বদলি করা হল, তখন তো প্রদীপবাবু এসএসকেএমের অধিকর্তা হিসেবে প্রতিবাদ করেননি। তা হলে নিজের ক্ষেত্রে তাঁর এমন অবস্থান কেন?
অভিমান রয়েছে সাগর দত্তের পড়ুয়াদের মধ্যেও। দ্বিতীয় বর্ষের এক পড়ুয়া বুধবার বলেন, ‘‘আমাদের কথাটা কেউ ভাবল না। স্বাস্থ্য দফতর তো নয়ই, প্রদীপবাবুও নয়। সবে ৬০-৬৫ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। উনি ওঁর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সেটা ১০০% করতে পারতেন। সেটা না করে উনি আমাদের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিলেন।’’
এই কথা শুনে প্রদীপবাবুর বক্তব্য, ‘‘আমাকে সাগর দত্তের মান উন্নয়নের জন্য নিয়ে যাওয়ার কথা বললে সানন্দে যেতাম। কারণ সেই যাওয়ার মধ্যে সম্মান ছিল। এ ক্ষেত্রে তো অসম্মান করার জন্যই রাতারাতি এই সিদ্ধান্তটা নেওয়া হয়েছে। আমি তো স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তার চেয়েও সিনিয়র। আমাকে এ ভাবে বদলি করে কী ভাবে? সাগর দত্ত বলে নয়, অন্য কোনও মেডিক্যাল কলেজে বদলি করলেও আমি এটাই করতাম।’’
এক রাতেই প্রাক্তন তকমা যোগ যাওয়া অধ্যক্ষ দেবাশিসবাবু অবশ্য বলেছেন, ‘‘যত দিন না পূর্ণ সময়ের অধ্যক্ষ কাজে যোগ দিচ্ছেন, তত দিন আমি যতটা সম্ভব সাহায্য করব।’’