বিচারপতি রাজাশেখর মান্থার গড়ে দেওয়া সিটে রয়েছেন দময়ন্তী সেন, উপেন্দ্রনাথ বিশ্বাস এবং পঙ্কজ দত্ত। নিজস্ব চিত্র।
উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জে নাবালিকাকে গণধর্ষণ করে খুনের অভিযোগের ঘটনায় বৃহস্পতিবার কলকাতা হাই কোর্টের সিট গঠনের নির্দেশ এবং তার সদস্য নির্বাচন নিয়ে রাজ্য জুড়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। উচ্চ আদালতের বিচারপতি রাজাশেখর মান্থা ওই ঘটনার তদন্তে তিন সদস্যের সিট (বিশেষ তদন্তকারী দল) গঠন করার সময় পর্যবেক্ষণে জানিয়েছেন, পুলিশ প্রচণ্ড ‘চাপ’-এর মুখে কাজ করতে পারছে না! সেই কারণেই এই সিট গঠন। যে তদন্তকারী দলে রয়েছেন এক বর্তমান আইপিএস দময়ন্তী সেন এবং দুই প্রাক্তন আইপিএস উপেন বিশ্বাস ও পঙ্কজ দত্ত। ঘটনাচক্রে, এই তিন জনেরই কোনও না কোনও সময়ে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার ইতিহাস রয়েছে। বিশেষ করে সেই কারণেই কি তাঁদের এই নিয়োগ? না কি বিষয়টি একেবারেই কাকতালীয়?
তৃণমূল অবশ্য মনে করছে না, বিষয়টি কাকতালীয়। দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ সরাসরিই বলেছেন, ‘‘টিভি চ্যানেলে বিষোদ্গার করাটাই কি আসল? রাজ্যে আইপিএস অফিসার কি কম পড়িয়াছিল?’’ পাশাপাশিই অবশ্য কুণাল বলেছেন, ‘‘এঁরা প্রত্যেকেই যোগ্য এবং স্বীকৃত। সবই ঠিক আছে। দময়ন্তী সেনকে নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। কিন্তু বাকিরা তো চ্যানেলে বসে বিষোদ্গার করেন! সেই কারণেই কি তাঁদের সিটের সদস্য করা হয়েছে?’’
দময়ন্তী সেন: ২০১২ সালে পার্ক স্ট্রিট গণধর্ষণকাণ্ডের তদন্তে দময়ন্তীর ভূমিকা বিভিন্ন স্তরে প্রশংসিত হয়েছিল। বর্তমানে রাজ্য পুলিশের আধিকারিক দময়ন্তী এক দশক আগে ঘটে যাওয়া পার্ক স্ট্রিট গণধর্ষণ মামলার সময় কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দাপ্রধান ছিলেন। তিনিই ওই ঘটনার তদন্ত করেছিলেন। ঘটনাচক্রে, তখন সদ্য ক্ষমতায়-আসা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ওই ঘটনাকে ‘সাজানো ঘটনা’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। যদিও তদন্তের প্রেক্ষিতে ধর্ষণ হয়েছে বলেই রিপোর্ট দিয়েছিলেন দময়ন্তী। তিনি তা সর্বসমক্ষে জানিয়েও ছিলেন। যা নিয়ে বিস্তর টানাপড়েনও চলে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক স্তরে। তার পর দীর্ঘ দিন দময়ন্তীকে কোনও ‘গুরুত্বপূর্ণ’ পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। আপাতত তিনি কলকাতা পুলিশে কর্মরত। কিছু দিন আগে দময়ন্তীকে আরও একটি সিটের সদস্য মনোনীত করেছিলেন কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। ঘটনাচক্রে, যাঁর সঙ্গে রাজ্য সরকারের সংঘাতের কথা সকলেই জানেন।
উপেন বিশ্বাস: এককালে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইয়ের যুগ্ম অধিকর্তা ছিলেন উপেন। বিহারে পশুখাদ্য কেলেঙ্কারির ঘটনায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদবকে গ্রেফতার করেছিলেন তিনি। অবসরগ্রহণের পর উপেন রাজনীতিতে যোগ দেন। যোগ দেন বাংলার বর্তমান শাসকদল তৃণমূলেই। তৃণমূলের টিকিটে জিতে রাজ্যের মন্ত্রীও হন। পরে অবশ্য শাসকদলের একাংশের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে দল ছাড়েন উপেন। সম্প্রতি সারা রাজ্যে শোরগোল ফেলে দেওয়া নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় তাঁর নাম আবার প্রকাশ্যে এসেছে। ঘটনাচক্রে, তৃণমূলের সঙ্গত্যাগের পরেই সমাজমাধ্যমে একটি ভিডিয়ো প্রকাশ করেছিলেন উপেন। সেখানে তিনি দাবি করেছিলেন, উত্তর ২৪ পরগনায় চাকরি দুর্নীতির চক্র চালান ‘সৎ রঞ্জন’! সেই সময় ‘গোপনীয়তার স্বার্থে’ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আসল নাম উল্লেখ করেননি উপেন। তাঁর নাম চন্দন মণ্ডল। যাঁকে পরে আদালতেও তলব করা হয়। কিন্তু তাঁর সেই অভিযোগই পরবর্তী কালে নিয়োগ দুর্নীতি মামলার তদন্তে নতুন মাত্রা যোগ করে।
পঙ্কজ দত্ত: অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস অফিসার পঙ্কজ দত্ত এক সময়ে রাজ্য পুলিশের আইজি ছিলেন। এই প্রাক্তন পুলিশ আধিকারিকের নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে সম্প্রতি বিতর্কে জড়িয়েছে রাজ্য সরকার। ২০১১ সালে রাজ্য পুলিশের আইজি পদ থেকে অবসর নেন পঙ্কজ। প্রাক্তন আইজি হিসাবে একজন নিরাপত্তারক্ষী পেতেন তিনি। অভিযোগ, সম্প্রতি কিছু না জানিয়েই তাঁর নিরাপত্তা প্রত্যাহার করে নিয়েছিল রাজ্য সরকার। তার বিরুদ্ধে কলকাতা হাই কোর্টের দ্বারস্থ হন পঙ্কজ। ঘটনাচক্রে, সেই মামলা বিচারপতি মান্থার এজলাসেই উঠেছিল। মামলার শুনানিতে বিচারপতি মান্থা তাঁর পর্যবেক্ষণে বলেছিলেন, ‘‘যদি নিরাপত্তা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তা হলে সব অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিকের ক্ষেত্রেই তা হওয়া উচিত।’’ সেই মামলায় রাজ্য সরকারের কাছে রিপোর্টও তলব করেছিল উচ্চ আদালত। আদালতের নির্দেশে পঙ্কজের নিরাপত্তা ফিরিয়ে দেয় রাজ্য সরকার। উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক কালে সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে শাসকদলের কড়া সমালোচনা করতে দেখা গিয়েছে পঙ্কজকে।
বিচারপতি মান্থা যে তিন সদস্যকে মনোনীত করেছেন, তাঁদের কারও বিরুদ্ধে কখনও ‘রাজ আনুগত্য’-এর প্রশ্ন ওঠেনি। প্রশ্ন ওঠেনি তাঁরা কর্মরত থাকার সময় তাঁদের কাজ বা পেশাদারিত্ব নিয়েও। কিন্তু সকলেরই কোনও না কোনও ভাবে, কোনও না কোনও সময়ে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার ইতিহাস রয়েছে। প্রশাসনিক সূত্রের একাংশের দাবি, কালিয়াগঞ্জের ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে কর্তব্যে গাফিলতি এবং নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ উঠেছে। সেই কারণে এমন তিন জনকে বেছে নেওয়া হয়েছে, যাঁরা তদন্তের নিয়মনীতি এবং প্রশাসনিক বিষয় সম্পর্কে সম্যক অবহিত। তদন্তের সময় তাঁরা ‘নিরপেক্ষ’ থাকবেন। তবে অন্য একটি মহলের দাবি, কালিয়াগঞ্জের ঘটনায় প্রথম থেকেই সিবিআই তদন্তের দাবিতে সরব হয়েছে নির্যাতিতার পরিবার। এই পরিস্থিতিতে হাই কোর্ট সিটে এমন এক জনকে (উপেন বিশ্বাস) নিয়ে এল, যিনি অতীতে সিবিআইয়ের দায়িত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন এবং লালু প্রসাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চালিয়ে গিয়েছেন। প্রসঙ্গত, দময়ন্তীকে অতীতেও একাধিক ধর্ষণের ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছে উচ্চ আদালত।
উল্লেখ্য, তিন সদস্যের সিট গঠনের পাশাপাশি বিচারপতি মান্থা জানিয়ে দেন, প্রয়োজন মনে করলে আরও সদস্য নিয়োগ করতে পারবে সিট। তদন্তে সিটকে সব রকম ভাবে সাহায্য করবে রাজ্য। কেস ডায়েরি ও অন্যান্য নথি সিটকে দেবে পুলিশ। জাতীয় শিশু সুরক্ষা কমিশন-সহ বাকিরা রিপোর্ট ও তথ্য সিটকে দিতে পারবে। তদন্ত চলাকালীন প্রকাশ্যে নিজেদের মতামত প্রকাশ করবেন না সিটের সদস্যেরা।