মদন মিত্রের মন্তব্য নিয়ে তরজা রাজ্য-রাজনীতিতে। ফাইল ছবি।
পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে আবারও বিরোধীদের কার্যত হুঁশিয়ারি দিয়ে বিতর্কে জড়ালেন মদন মিত্র। ভোটের ‘খেলা শুরু’ হয়ে গিয়েছে বলে দাবি করে কামারহাটির তৃণমূল বিধায়কের মন্তব্য, ‘‘কোদাল-কাস্তে হাতে থাকলে বিজেপির দস্যু-ডাকাতরা জমি দখল করতে পারবে না। বুথে এজেন্টই দিতে পারবে না।’’
মদনের ওই মন্তব্য নিয়ে তরজা শুরু হয়েছে রাজ্য-রাজনীতিতে। শাসকদলকে পাল্টা আক্রমণ করেছে বিরোধীরা। ‘গাজোয়ারি’ করে পঞ্চায়েত ভোটে জেতা যাবে না বলে দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে আগেই বার্তা দিয়ে রেখেছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। শীর্ষনেতৃত্বের সেই ‘নির্দেশ’ অমান্য করে মদন কেন এমন মন্তব্য করলেন, তা নিয়ে দলের অন্দরেও আলোচনা শুরু হয়েছে।
তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেছেন, ‘‘অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যা বলেছেন, সেটাই পার্টির লাইন। অবাধ, গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হবে। উন্নয়ন এবং পরিষেবার উপর দাঁড়িয়ে আমি মানুষের কাছে ভোট চাইব। এর কোনও বাইরে কারও কোনও মন্তব্য নিয়ে কিছু বলব না।’’ অর্থাৎ, প্রকারান্তরে মদনের ‘হুঁশিয়ারি’ থেকে দূরত্বই তৈরি করছে তৃণমূল।
রবিবার উত্তর ২৪ পরগনার ঘোলা বিলকান্দা ১ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের উদ্যোগে কৃষকদের কোদাল ও শীতবস্ত্র বিতরণ অনুষ্ঠান ছিল। মদনের পাশাপাশি ওই অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন দমদমের তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়ও। সেই মঞ্চ থেকেই মদন বলেন, ‘‘খেলা কিন্তু শুরু হয়ে গেল বিলকান্দা থেকে। সিপিএম, বিজেপি শুনে রাখো, এই সভা থেকেই কোদাল আর কাস্তে নিয়ে খেলা শুরু হয়ে গেল। গেট রেডি ফর ফাইনাল ম্যাচ। উই আর রেডি। ৯০ মিনিটও খেলতে হবে না। প্রথম পাঁচ মিনিটেই খেলা শেষ হয়ে যাবে।’’
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ্যেই একবার মদনকে ‘কালারফুল বয়’ বলে অভিহিত করেছিলেন। সেই মদনের মন্তব্য, ‘‘আমরা বুথ থেকে ১ কিলোমিটার দূরে থাকব। আর বোকার দল খালি বলছে, তৃণমূল হামলা করবে! তৃণমূল দখল নেবে! আরে ভোট হলে তো দখল নেবে? ভোটই তো হবে না! অন্য কোনও কারণ নয়। বুথে তো এজেন্টই দিতে পারবে না ওরা। কিন্তু আমরা কী করব? ক্যান্ডিডেটই তো নেই। হাতে কোদাল-কাস্তে থাকলে বিজেপির দস্যু-ডাকাতরা জমি দখলই করতে পারবে না।’’
মদনের এই মন্তব্যের প্রেক্ষিতে বিরোধীদের বক্তব্য, হঁশিয়ারি দিয়ে আসলে প্রচারের আলোয় আসতে চাইছেন বিধায়ক। বিজেপির বারাসত সাংগঠনিক জেলার সভাপতি তাপস মিত্র বলেন, ‘‘মদন মিত্রের মন্তব্য নিয়ে আমরা ভাবিত নই। তবে হ্যাঁ, মদন মিত্র যত এই ধরনের কথা বলবেন, তত তৃণমূলের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। বিজেপির পথ আরও মসৃণ হবে।’’ সিপিএমের জেলা সম্পাদক মৃণাল চক্রবর্তীও বলেন, ‘‘মদন মিত্রের কথার কী জবাব দেব! উনি আর কী খেলবেন? খেলবেন তো আসলে মানুষ।’’
ইতিমধ্যেই পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে শাসকদলের একাধিক নেতার বিরুদ্ধে বিরোধীদের ‘হুঁশিয়ারি’ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। শনিবার বিকেলে নদিয়ার চাপড়ায় রাজ্যের মন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাস এবং স্থানীয় বিধায়ক রুকবানুর রহমানের উপস্থিতিতে তৃণমূলের ব্লক সভাপতি শুকদেব ব্রহ্মের মন্তব্য নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। শুকদেব বলেছেন, ‘‘ভোটের দিন বিরোধীরা যাতে ঘর থেকে বাইরে বেরোতে না পারে, সেটা দেখতে হবে। ওদের ঘরে ঢুকিয়ে দেব। বের হতে দেব না।’’ তার পরেই মদনের মন্তব্য।
তৃণমূল সূত্রে খবর, পঞ্চায়েত নির্বাচনে ‘অহিংসপথে’ই বিরোধীদের মোকাবিলার বার্তা দিয়েছেন শীর্ষনেতৃত্ব। স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, পঞ্চায়েত ভোটে কোনও রকম বিশৃঙ্খলা দল বরদাস্ত করবে না। ঐক্যবদ্ধ হয়ে মানুষের মন জয় করে তাঁদের পাশে থেকে কাজ করতে হবে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে যে সরকারি পরিষেবা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে, সেই বিষয়গুলি নিয়ে নিচুতলায় প্রচারে জোর দিতেও বলা হয়েছে। তা সত্ত্বেও দলীয় নীতি অমান্য করে নেতারা কেন বিতর্কিত মন্তব্য করছেন, তা নিয়ে দলের অন্দরেই প্রশ্ন উঠছে।
শুধু বিরোধীরা নন, বিলকান্দার মঞ্চ থেকে সতীর্থ তথা রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমকেও নিশানা করেছেন মদন। পঞ্চায়েত ভোটের মুখে কর্মীদের অস্ত্র প্রশিক্ষণের বিধান দিয়ে দলের অন্দরেই এর আগে এক বার বিতর্কে জড়িয়েছিলেন মদন। নাম না করে তার সমালোচনা করে মন্ত্রী ফিরহাদ বলেছিলেন, ‘‘পাগলে কিনা বলে, ছাগলে কিনা খায়!’’ ফিরহাদের ওই মন্তব্যের জবাবে মদন পাল্টা বলেছেন, ‘‘আমরা দুই ভাই। আমি ছাগল হলে, উনিও তাই।’’
দলের মধ্যে ‘দ্বন্দ্ব’ জিইয়ে রাখার এই প্রবণতাকেও শীর্ষনেতৃত্ব সুনজরে দেখছেন না বলেই দাবি তৃণমূল সূত্রের। দলের এক রাজ্য স্তরের নেতার কথায়, ‘‘পার্টি নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। স্বছতা বজায় রেখে সংগঠনকে শক্তিশালী করতে সবাইকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে। নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি করা চলবে না। আমাদের সকলের উচিত, শীর্ষনেতৃত্বের নির্দেশ মেনে চলা। তা না করে এই ধরনের মন্তব্য করলেন দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হবেই।’’
শীর্ষনেতৃত্বের নির্দেশ অমান্য করার পরেও কেন মদনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা হবে না, দলের মধ্যে সেই প্রশ্নও উঠেছে বলে একটি সূত্রের দাবি। প্রসঙ্গত, অতীতেও একাধিক বার বিতর্কিত মন্তব্য করার জন্য মদনকে ‘সেন্সর’ করেছে দল। গত অগস্ট মাসেই শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির তরফে বিধায়ককে সংবাদমাধ্যমের সামনে মুখ খুলতে নিষেধ করা হয়েছিল। এ বারও তৃণমূল শীর্ষনেতৃত্ব তেমন কোনও সিদ্ধান্ত নেবেন কি না, সেটাই দেখার।