অসম্পূর্ণ এসআরএস রিপোর্ট

রাজ্যে শিশুমৃত্যুর হার নিয়ে বিভ্রান্তি চরমে

পশ্চিমবঙ্গে নবজাতক মৃত্যুর হার নিয়ে রাজ্য সরকারের দাবি কতটা যথার্থ, সেই প্রশ্নের মীমাংসা এখনও ঝুলেই রইল। গত এপ্রিলে বিধানসভা ভোটের মুখে খানিক স্বস্তি পেয়েছিল রাজ্যের শাসক দল।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০১৬ ১০:২২
Share:

পশ্চিমবঙ্গে নবজাতক মৃত্যুর হার নিয়ে রাজ্য সরকারের দাবি কতটা যথার্থ, সেই প্রশ্নের মীমাংসা এখনও ঝুলেই রইল।

Advertisement

গত এপ্রিলে বিধানসভা ভোটের মুখে খানিক স্বস্তি পেয়েছিল রাজ্যের শাসক দল। স্বাস্থ্য মন্ত্রক থেকে প্রকাশিত ‘ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে’ (এনএফএইচএস)-র রিপোর্টে বলা হয়েছিল, গত দশ বছরে রাজ্যে নবজাতক মৃত্যুর হার ২১ ভাগ কমে গিয়েছে। প্রতি হাজারে ৪৮ থেকে কমে হয়েছে ২৭।

কিন্তু কেন্দ্রে নবজাতক স্বাস্থ্য সুরক্ষার নীতি ও প্রকল্প রচনার দায়িত্বে থাকা বিশেষজ্ঞ কমিটি এতে নিঃসংশয় হতে পারেনি। তারা অপেক্ষা করছিল আর একটি রিপোর্টের জন্য। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অন্তর্গত ‘রেজিস্ট্রার জেনারেল ইন্ডিয়া’ প্রকাশিত ‘স্যাম্পল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম’ (এসআরএস) সমীক্ষার রিপোর্ট। ওই রিপোর্টে ২০১৩ সালে দেখা গিয়েছিল, শেষ তিন বছরে রাজ্যে নবজাতক মৃত্যু এক জায়গায় (প্রতি হাজারে ৩১-এ) থমকে রয়েছে। ২০১৪ সালের রিপোর্টটি সেই কারণেই বিশেষজ্ঞ কমিটির কাছে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল।

Advertisement

নির্দিষ্ট সময়ের থেকে প্রায় ছ’মাস দেরিতে ২০১৪ সালের সেই এসআরএস রিপোর্ট এ বছরের ১৪ জুন প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, রিপোর্টটি অসম্পূর্ণ! তাতে পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, কেরল, মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, পঞ্জাব, জম্মু-কাশ্মীর সহ ১৩টি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যের তথ্য নেই। কবে তা পাওয়া যাবে, সেই প্রশ্নের কোনও নির্দিষ্ট জবাবও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দিতে পারেননি। ফলে সত্যিই এ রাজ্য নবজাতক-মৃত্যু রোধে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করতে পেরেছে কি না, তার উত্তর অধরাই রইল।

স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় বিশেষজ্ঞ কমিটির আফশোস, এসআরএস রিপোর্টের এই অসম্পূর্ণতার জন্য পশ্চিমবঙ্গ-সহ বিভিন্ন রাজ্যের নবজাতক-স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নতুন প্রকল্প এবং নীতি তৈরি করা করা যাচ্ছে না। রাজ্যগুলি নবজাতক স্বাস্থ্যের বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে কেন্দ্রকে ‘প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন প্ল্যান’ (পিআইপি) পাঠিয়েছে। জুন মাস শেষ হতে চললেও তা যাচাই করে টাকা অনুমোদন করা যাচ্ছে না। এ রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তারা অবশ্য এই যুক্তি মানতে নারাজ। রাজ্যের মা ও শিশু-স্বাস্থ্যে নজরদারির জন্য গঠিত টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, এনএফএইচএস রিপোর্টের পরেও এত সংশয়ের প্রশ্নই ওঠে না। তিনি বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে নবজাতক মৃত্যুর হার এক ধাক্কায় চোখে পড়ার মতো কমেছে। আমাদের নীতি নিয়ে, বেশি সংখ্যায় এসএনসিইউ খোলা নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি নীতির ক্ষেত্রে আমরাই যে ঠিক, তা প্রমাণিত হয়ে গিয়েছে। তাই এখন ঈর্ষান্বিত হয়ে কিছু লোক ওই তথ্য ‘বিশ্বাসযোগ্য নয়’ বলে রটাচ্ছে। বিভিন্ন প্রকল্পে কেন্দ্রের টাকা ছাড়তেও দেরি করছে।’’

মানগত কী পার্থক্য রয়েছে ওই দুই রিপোর্টের মধ্যে? কেন্দ্রীয় সরকারের শিশুস্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টা, নিওনেটোলজিস্ট অরুণ সিংহ (যিনি দীর্ঘদিন কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালের নিওনেটোলজির প্রধান ছিলেন এবং যাঁর তত্ত্বাবধানে পুরুলিয়ায় পশ্চিমবঙ্গের প্রথম ‘সিক নিওনেটাল কেয়ার ইউনিট’ তৈরি হয়) জানিয়েছেন, এসআরএস রিপোর্ট প্রতি বছর প্রকাশিত হয়। ভারত জুড়ে বিশাল সংখ্যক জনসংখ্যার উপর এই সমীক্ষা হয়। সমীক্ষার জন্য স্থানীয় ভাবে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সরকারি চিকিৎসকদের নিয়োগ করা হয়। এ ছাড়া প্রতি ছ’মাস অন্তর প্রতিটি এলাকায় আলাদা নজরদারি কমিটি সমীক্ষা চালায়। এই দু’টি রিপোর্ট একত্রিত করে মূল রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। তাই শিশুমৃত্যু হারের কমা-বাড়া বোঝার জন্য এই রিপোর্টই হল আসল মাপকাঠি। উল্টো দিকে, এনএফএইচএস রিপোর্ট প্রকাশিত হয় প্রতি ১০ বছর অন্তর। এটি অনেক কম জনসংখ্যার উপর করা হয়। এর সমীক্ষকেরাও নির্দিষ্ট নয়। ফলে এর নির্ভরযোগ্যতা কম। বহু ক্ষেত্রেই দুটি রিপোর্টে উল্টো ছবি ধরা পড়েছে। বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যকর্তারা কয়েকটি উদাহরণ দিয়েছেন। যেমন, এনএফএইচএস-৪ অনুযায়ী, মেঘালয়ের শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৩০, কিন্তু ওই একই সময় করা এসআরএস রিপোর্ট অনুযায়ী সংখ্যাটা ৪৬। এনএফএইচএস-৪ অনুযায়ী, মণিপুরে শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজার শিশুতে ২২। আবার ওই একই সময় করা এসআরএস রিপোর্ট অনুযায়ী সংখ্যাটা ১১।

প্রশ্ন উঠছে, খোদ শিশু স্বাস্থ্য বিষয়ক কেন্দ্রীয় বিশেষজ্ঞ কমিটিই যদি স্বাস্থ্য মন্ত্রক-প্রকাশিত এনএফএইচএস রিপোর্টে ভরসা না করে, তা হলে এমন রিপোর্ট প্রকাশ করার অর্থ কী? স্বাস্থ্য মন্ত্রকের জয়েন্ট ডিরেক্টর রাজেশ্বর রাওয়ের জবাব, ‘‘এটা সরকারের নীতিগত ব্যাপার। আমলারা তাতে মন্তব্য করতে পারেন না। আমরা নির্দেশ পালন করি।’’

কোন রিপোর্টটি বেশি নির্ভরযোগ্য? এনএফএইচএস নাকি এসআরএস? ভারতের ডেপুটি কন্ট্রোলার জেনারেল রোহিত ভরদ্বাজ বলেন, ‘‘এর উত্তর আমরা দিতে পারব না। সরকার দিতে পারবে।’’ এই পরিস্থিতিতে রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তারা হাপিত্যেশ করে বসে রয়েছেন কবে এসআরএস রিপোর্টটি সম্পূর্ণ আকারে বেরোবে। সাফল্যের প্রচারের ঢাকে কাঠি দিতে আপাতত এ ছাড়া পথ নেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement