ফরাক্কায় তখনও চলছে বিক্ষোভ।—নিজস্ব চিত্র।
পথে নেমে ‘নজিরবিহীন দাবি’ আদায় করে ছাড়লেন শ্রমিকেরা। সঙ্ঘবদ্ধ শ্রমিকদের অনড় দাবির কাছে পিছু হটল এনটিপিসি-র ফরাক্কা তাপবিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ।
মৃত শ্রমিকের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ ও চাকরির দাবি মেনে বুধবার রাতেই পরিবারের হাতে আপাতত তুলে দেওয়া হল নগদ ২ লক্ষ টাকা। মঙ্গলবার দুপুরে এনটিপিসি-র পূবারুণ আবাসনে কর্মরত অবস্থায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু হয় ফরাক্কা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ঠিকা শ্রমিক রেকাবুদ্দিন শেখের। তারপর থেকে গত ৪৮ ঘণ্টা ধরে কখনও মৃতদেহ আটকে রেখে, কখনওবা এনটিপিসির মূল ফটকের সামনে ধর্ণা, বিক্ষোভ চালিয়ে যান প্রায় ৩ হাজার শ্রমিক। শুরু হয় কর্মবিরতিও। বুধবার রাতে ময়নাতদন্তের পরে মৃতদেহ ধর্ণা মঞ্চের সামনে নিয়ে এলে শ্রমিক সমাবেশে উত্তেজনা চরমে ওঠে।
আন্দোলনরত শ্রমিকদের ‘সংগ্রাম কমিটি’ রাত ৯টা নাগাদ ঘোষণা করে বৃহস্পতিবার থেকে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র অবরোধের। দু’পক্ষের অনড় মনোভাবে এনটিপিসি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে শ্রমিকদের আলোচনাও ভেস্তে যায়। এর মাঝে এনটিপিসি কর্তৃপক্ষ লিখিত বিবৃতি দিয়ে জানায়, ‘শ্রমিকদের দাবি অবাস্তব এবং অযৌক্তিক। তাই তা মানা সম্ভব নয়।’ পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে বুঝে বুধবার গভীর রাতে শ্রমিকদের ধর্ণা মঞ্চের সামনে গিয়ে বিক্ষোভরত শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন ফরাক্কার বিডিও ও ফরাক্কা থানার আইসি। সেখানে ডেকে নেওয়া হয় এনটিপিসির অতিরিক্ত জেনারেল ম্যানেজার (মানবসম্পদ) মিলনকুমারকেও।
ফিডার ক্যানেলের ধারে আন্দোলন মঞ্চের পাশে টানা তিন ঘণ্টা চলে আলোচনা। এনটিপিসি ফরাক্কা প্রকল্পের কর্তারা শ্রমিকদের দাবি ও পরিস্থিতির কথা জানান দিল্লির এনটিপিসি-র কর্তাদের। সেখান থেকে সবুজ সঙ্কেত মিলতে গভীর রাতে শ্রমিকদের জানানো হয়, ‘মৃত শ্রমিকের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ ও চাকরির দাবি মেনে নিচ্ছে এনটিপিসি কর্তৃপক্ষ।’ মাঝরাতেই উল্লাসে ফেটে পড়ে রাত জাগা কয়েক হাজার শ্রমিক। মিলনকুমার বলেন, ‘‘রেকাবুদ্দিনের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ বাবদ ৪ লক্ষ টাকা দেওয়া হবে। এ দিন রাতেই ২ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছে। এক মাসের মাথায় বাকি টাকাও দেওয়া হবে।’’ এ ছাড়াও রেকাবুদ্দিনের পরিবার বিমা বাবদ পাবেন আরও প্রায় ৬ লক্ষ টাকা। সে টাকাও দ্রুত পরিবারের হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। রেকাবুদ্দিন যেখানে ঠিকা শ্রমিক পদে কাজ করতেন, সেখানেই তাঁর এক ছেলেকেও নিয়োগ করা হবে বলে মিলনবাবু জানিয়েছেন।
এনটিপিসির ফরাক্কা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইতিহাসে এটাকে নজিরবিহীন ঘটনা বলে ব্যাখ্যা করেছেন সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক অমর চক্রবর্তী। তিনি বলেন, ‘‘আমরা প্রমাণ করেছি সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা থাকলে জোট বেঁধে সব বাধাই জয় করা যায়।’’ কমিটির কোষাধ্যক্ষ আনোয়ার কবীরের অভিযোগ জানান, প্রায় ৩০ বছর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হয়েছে। বহু শ্রমিক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু ৪টি স্বীকৃত রাজনৈতিক দলের শ্রমিক সংগঠন কার্যত কিছুই করেনি তাদের জন্যে। ফলে বহু মৃত শ্রমিকের পরিবার এখন ধুঁকছে। কমিটির ক্ষোভ, শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের অলিখিত বোঝাপড়ার ফলেই বঞ্চিত হয়েছেন শ্রমিকেরা। তাই রাজনীতির সঙ্গ ত্যাগ করে তাঁরা একজোট হয়ে পথে নেমেছিলেন।
কিন্তু, এনটিপিসি হঠাৎ নরম হল কী করে?
বুধবার মাঝরাতে রাজ্য সরকারের তরফে যে দু’জন মধ্যস্থতায় এগিয়ে এসেছিলেন তাঁদের একজন ফরাক্কার বিডিও সুব্রত চক্রবর্তী। তিনি বলেন, ‘‘সব কিছুরই সমাধানের পথ আলোচনা। সেটাই করা হয়েছে এ দিন।’’ সকলেই এনটিপিসির এই মানবিক ভূমিকার প্রশংসা করেছেন। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মুখ্য জনসংযোগ অধিকর্তা শৈবাল ঘোষ জানান, কর্মীরা কাজে ফেরায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে অচলাবস্থার আশঙ্কা কেটেছে। ফরাক্কার ৬টি ইউনিটে বিদ্যুৎ উৎপাদন স্বাভাবিক হয়েছে। এ দিকে অরাজনৈতিক শ্রমিক আন্দোলনের সাফল্য অস্বস্তিতে ফেলেছে শ্রমিক সংগঠনগুলিকে।