রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়
পরীক্ষার মধ্যে ভোটের প্রচারে মাইক বাজানোর অনুমতি দিয়ে বিভিন্ন শিবিরের প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছেন তিনি। সেই রাজ্য নির্বাচন কমিশনারই এ বার পুরভোটের প্রচারে বাইকবাহিনীর তাণ্ডব রুখতে উদ্যোগী হলেন। প্রচারে বাইক-মিছিল করলে শাস্তির ব্যবস্থা করার নির্দেশও দিয়েছেন তিনি।
রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব, রাজ্য পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেল ও কলকাতার পুলিশ কমিশনারের কাছে চিঠি পাঠিয়ে অবিলম্বে পুরভোটের প্রচারে মোটরবাইক বাহিনীর দাপট বন্ধ করতে বলেছে কমিশন। শনিবার কমিশনের অফিস থেকে এই মর্মে পাঠানো চিঠিতে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায় লিখেছেন, যে-সব অঞ্চলে পুরভোট আসন্ন, সেখানে এখনই বাইক-মিছিল বন্ধ করতে হবে। নিয়ম ভেঙে বাইক-মিছিল করলে শাস্তি দিতে হবে।
বিভিন্ন পুর এলাকায় শাসক দলের বাইক-বাহিনীর তাণ্ডব নিয়ে কমিশনে অভিযোগ জানিয়েছিল বিরোধী শিবির। কমিশন সূত্রের খবর, সেই সব অভিযোগের ভিত্তিতেই এ বার বাইকবাহিনীর তাণ্ডব প্রতিরোধে নেমেছেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার। প্রশাসন ও পুলিশের কর্তাদের কাছে পাঠানো চিঠিতে সুশান্তবাবু লিখেছেন, পুরভোটে রাজনৈতিক দলের কর্মীরা যে-সব মোটরবাইক মিছিল করছেন, তা থেকে অনেক এলাকায় সন্ত্রাসের পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রার্থীদের হুমকি-মারধরের ঘটনাও ঘটছে বলে তাঁরা জেনেছেন। একাধিক রাজনৈতিক দল এই বিষয়ে কমিশনে অভিযোগ দায়ের করেছে। তাদের সেই অভিযোগের উল্লেখ করে চিঠিতে লেখা হয়েছে, বাইকবাহিনীর দাপটে বহু জায়গাতেই ভোটারদের মধ্যে সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়েছে।
পুরভোটের ঢাকে কাঠি পড়ার পর থেকেই কলকাতা এবং বিভিন্ন জেলায় রাজনৈতিক হাঙ্গামা ও সন্ত্রাসের অভিযোগ উঠছে। এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অভিযোগের তির শাসক দলের দিকে। রাজ্য নির্বাচন কমিশনার অবশ্য তাঁর চিঠিতে সরাসরি কোনও বিশেষ দলের নাম করেননি। তবে বাইকবাহিনীর দাপট রুখতে বলে তিনি ঠারেঠোরে শাসক দলের কর্মী-সমর্থকদের কাজকর্মে আইনি লাগাম টানার নির্দেশ দিয়েছেন বলেই মনে করছে রাজনৈতিক শিবির।
অনেক ছাত্রছাত্রীর পরীক্ষা চলাকালীন ভোটের প্রচারে মাইক বাজানোর অনুমতি দিয়ে যিনি বিতর্কের মুখে পড়েছেন, সেই নির্বাচন কমিশনারের এই উদ্যোগ নিয়ে কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে সুশান্তবাবুর পূর্ববর্ত়ী রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডের সঙ্গে রাজ্য সরকারের সংঘাতের প্রেক্ষাপটে মাত্রা বেড়েছে জল্পনার। ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে সরকারের সঙ্গে মীরাদেবীর আইনি লড়াই ঐতিহাসিক তকমা পেয়েছে। মীরাদেবীর বিরুদ্ধে তোপ দাগতেও কসুর করেননি শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীরা। তার পরেই ডব্লিউবিসিএস অফিসার সুশান্তবাবুকে ওই পদে বসানো হয়।
অথচ রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের পদে বিসিএস অফিসার বসানোর রেওয়াজ ছিলই না। ওই পদে মূলত প্রাক্তন আইএএস অফিসারেরাই মনোনীত হতেন। সেই রীতি ভেঙে সুশান্তবাবুর নিয়োগের বিষয়টি বিতর্ক উস্কে দিয়েছিল। অনেকেই বলছেন, শাসক দলের মনপসন্দ প্রার্থী হিসেবেই সুশান্তবাবুকে ওই পদে বসানো হয়। এখন প্রশ্ন উঠছে, শাসক দলের পছন্দের পদাধিকারী হয়েও রাজ্য নির্বাচন কমিশনার ভোট-প্রচার নিয়ে এ ভাবে তোপ দাগছেন কেন?
এই সক্রিয়তার পিছনে মাইক-বিতর্কের অবদানও থাকতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে। তা ছাড়া ৩০ মার্চ অন্য একটি নির্দেশিকায় সুশান্তবাবু জানিয়েছিলেন, তিনি জেলা থেকে নিয়মিত আইনশৃঙ্খলার রিপোর্ট পাচ্ছেন না। রাজ্য প্রশাসনের একাংশের বক্তব্য, কমিশনের দায়িত্ব শান্তিপূর্ণ ভাবে ভোট করানো। বিভিন্ন বিরোধী দল যে-ভাবে লাগাতার সন্ত্রাসের অভিযোগ করছে, তাতে কমিশনের বিরুদ্ধেও নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ উঠছে। সেটা মাথায় রেখেই বারবার সরকারি কর্তাদের কাছে নির্দেশিকা পাঠাচ্ছেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার। ওই চিঠিতে তিনি লিখেছেন, শান্তিপূর্ণ ভোট করার দায়িত্ব কমিশনের। সেই জন্যই এই নির্দেশ জারি করা হচ্ছে।
রাজ্য প্রশাসনের তরফে অবশ্য দাবি করা হয়েছে, সব ভোটের আগেই বাইকবাহিনীর তাণ্ডব রুখতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এ বারেও তা করা হবে। রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘এখনও আমরা কমিশনের চিঠি পাইনি। সোমবার হয়তো পাব। তবে চিঠি না-এলেও বাইকবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াই হত।’’
স্বরাষ্ট্র দফতরের ওই কর্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয় বলে দাবি জানালেও তার সারবত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে চাঁপদানির রবিবারের ঘটনা। সেখানে পুলিশের উপরে হামলার পরে রাজ্য নির্বাচন কমিশনেরই এক কর্তার কটাক্ষ, ‘‘প্রশাসন বাইক-বাহিনী আটকাতে কতটা বদ্ধপরিকর, তা তো চাঁপদানির ঘটনাতেই টের পাওয়া যাচ্ছে! পুলিশ যদি কড়া হত, তা হলে কি বাইক পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে শাসক দলের কর্মী-সমর্থকেরা এ ভাবে হামলা চালাতে পারত?’’