রবিবার বিকেল ৪টে ৪২। নবান্নে ঢুকছেন মমতা। (ডান দিকে) সোমবার বেলা ১২টা ১৯-এ নবান্ন থেকে সোজা অশোকনগরের উদ্দেশে যাত্রা। ছবি: দেবাশিস রায় ও সুমন বল্লভ
মহাকরণে এমনটা হয়নি। হল নবান্নে।
রবিবার সন্ধ্যা ছ’টা। নবান্নের কনফারেন্স রুমে সাংবাদিকদের ডেকে তিনি রাজ্যের বন্যা পরিস্থিতির নিয়ে কথা বললেন। তারই রেশ টেনে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, ‘‘ম্যাডাম আপনি কি রাতে থাকবেন?’’ উত্তর এল, ‘‘দেখি। কেউ-না-কেউ থাকবেন।’’
সাংবাদিক বৈঠক সেরে মুখ্যমন্ত্রী নিজের ঘরে ফিরতেই প্রশাসনের শীর্ষকর্তাদের মধ্যে উসখুস শুরু হয়ে গেল, কার উপর সেই দায়িত্ব বর্তাবে! ওই সাংবাদিকের প্রশ্নে কোনও কোনও শীর্ষকর্তা অসন্তোষও প্রকাশ করলেন। এক জন তো এমনও বললেন, ‘‘কেন এমন উস্কানিমূলক প্রশ্ন করেন? কী দরকার ছিল রাতে থাকা নিয়ে প্রশ্ন করার?’’ জবাবে সাংবাদিক তাঁকে জানালেন, ইতিমধ্যে মুখ্যমন্ত্রী একটি টিভি চ্যানেলকে জানিয়ে এসেছেন তিনি রাতে থাকতে পারেন। শুনে প্রমাদ গুনলেন ওই কর্তা। পাশে দাঁড়ানো এক অনুজ অফিসারকে বললেন, ‘‘তোমার বয়স কম। মুখ্যমন্ত্রী থাকলে রাতে থেকে যেও। আমি নেই।’’
কর্তাদের আশঙ্কা সত্যি হল। রাত প্রায় আটটা নাগাদ সকলেই জেনে গেলেন, বন্যা পরিস্থিতি সামাল দিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে যাচ্ছেন নবান্নে।
রাজ্যে বন্যার ভ্রূকুটি দেখেই লন্ডন সফর ছেঁটে শুক্রবার রাতে কলকাতায় ফিরে এসেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শনিবারই ছুটে গিয়েছিলেন আমতা, উদয়নারায়ণপুর ও পুরশুড়ার কিছু দুর্গত এলাকায়। রবিবার সকাল থেকে বাড়িতে বসেই পরিস্থিতির উপর নজর রাখছিলেন। দলের সেনাপতিদের নানা রকম নির্দেশ দিচ্ছিলেন। কিন্তু ভরা কোটাল আর বিভিন্ন বাঁধ থেকে জল ছাড়ার খবর পেয়ে শেষ পর্যন্ত ছুটির বিকেলে নিজেই হাজির হন নবান্নে। নিজেই কন্ট্রোল রুমে দায়িত্ব নিয়ে জেলায় জেলায় ফোন ঘুরিয়ে তোপ দাগতে শুরু করেন। কখনও পশ্চিম মেদিনীপুরে যাওয়া সুব্রত মুখোপাধ্যায়, কখনও হুগলিতে যাওয়া ফিরহাদ হাকিম, নদিয়া পৌঁছনো পার্থ চট্টোপাধ্যায় কিংবা পুরুলিয়ায় যাওয়া পূর্ণেন্দু বসুকে ফোনে ধরে পরিস্থিতির তদারকি করেন। বাঁধের জল কতটা ছাড়া হল, কত গ্রামের লোকজনকে সরানো হয়েছে, ত্রিপল আছে কি না, শুকনো খাবার পর্যাপ্ত কি না— উত্তর দিতে দিতে হাঁপিয়ে ওঠেন জেলার সরকারি অফিসারেরা। রাত প্রায় একটা পর্যন্ত এই ভাবেই বারবার মুখ্যমন্ত্রীর ফোন গিয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-অফিসারদের কাছে।
তদারকির দায়িত্বে থাকা এক মন্ত্রীর কথায়, ‘‘যে কাজ সরকারি অফিসারের করার কথা, মুখ্যমন্ত্রী নিজেই সেই দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন। ফলে আমরা পড়েছি ফাঁপরে। মুখ্যমন্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, নৌকা পর্যাপ্ত আছে তো! আমি বললাম, হ্যাঁ। পরে জানলাম, ওই ব্লকে কোনও নৌকাই নেই।’’ আর এক জেলার অফিসার বলেন, ‘‘যখন জানলাম, মুখ্যমন্ত্রী নিজেই রাত জাগছেন তখন আর ঝুঁকি নেওয়া গেল না। আমারও রাত কাটল একটি জলাধারে।’’
রাজ্য প্রশাসনের বেশ কয়েক জন শীর্ষ কর্তাকেও নবান্নে ‘নাইট ডিউটি’ করতে হয়েছে। এবং তাঁরা জানিয়েছেন, জীবনে এই প্রথম সচিবালয়ে চেয়ারে বসেই রাত কাটালেন। রাতে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গী ছিলেন তাঁর নিরাপত্তা কর্মীরা ছাড়াও রাজ্য পুলিশের আইজি (আইনশৃঙ্খলা) অনুজ শর্মা, বিপর্যয় মোকাবিলা সচিব এস সুরেশ কুমার এবং মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের এক অফিসার। ছিলেন কন্ট্রোল রুমের দায়িত্বে থাকা কর্মী, নবান্নের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মী এবং জনা পঁচিশেক সাংবাদিক ও চিত্র সাংবাদিক। কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে যান আবাসন মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস এবং রাজ্যসভার সাংসদ দোলা সেন। আসেন বিপর্যয় মোকাবিলা মন্ত্রী জাভেদ খানও। যাঁরা রাতে নবান্নে ছিলেন, তাঁদের খাওয়ার ব্যবস্থাও করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর নির্দেশে দক্ষিণ কলকাতার একটি বড় রেস্তোরাঁ থেকে আনানো হয় ৮০ প্যাকেট বিরিয়ানি। তিনি নিজে অবশ্য রাতে মুড়ি খেয়েছেন বলে জানাচ্ছেন অফিসারেরা। নবান্নের খবর, রাত দেড়টা-দু’টো পর্যন্ত প্রশাসনের বিভিন্ন কর্তাদের ফোনাফুনি করার পর নিজের অ্যান্টিচেম্বারে গিয়ে গা এলিয়ে দেন মমতা। নিভে যায় ঘরের আলো।
বিরোধীদের কেউ কেউ অবশ্য এ দিন দাবি করেছেন, নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর এই রাত্রিযাপন হয়তো খানিকটা দায়ে পড়েও। কারণ, কালীঘাটে হাঁটুজল। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রর ট্যুইট, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী নবান্নে তাঁর অফিসে রাত কাটাচ্ছেন। কালীঘাটের জলস্তর কি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে?’’ কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নানের কটাক্ষ, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী টালিনালার জলে কোমর ডোবা কালীঘাট ছেড়ে নবান্নের পনেরো তলায় নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছেন!’’ শাসক দল অবশ্য এই সব অভিযোগে আমল দিচ্ছে না। নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর রাত জাগার ঘটনাকে অভূতপূর্ব বলে বর্ণনা করে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কেউ কখনও দেখেছেন, নবান্ন বা রাইটার্সে দুর্যোগ মোকাবিলায় মুখ্যমন্ত্রী নিজে রাত্রিবাস করছেন!’’
সোমবার রাতে নবান্ন ছেড়ে বাড়ি ফেরার সময়ে মমতা নিজে জানিয়ে যান, বীরভূমে জল নেমে গিয়েছে। উদয়নারায়ণপুর, আমতার পরিস্থিতিও নিয়ন্ত্রণে। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘আজ আমি আর থাকলাম না। বাড়ি থেকেও তো তদারকি করা যায়। আজকাল তো মোবাইলেই সব জানা যায়। আমার কাছে চার হাজার নম্বর রয়েছে।’’ নবান্নের খবর, আজ মঙ্গলবার মুখ্যমন্ত্রীর হেলিকপ্টারে বর্ধমান জেলায় বন্যা কবলিত এলাকা দেখতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু জল থইথই বর্ধমানে হেলিকপ্টার নামার জায়গা না পাওয়ায় তা বাতিল হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুর একটা নাগাদ জেলাশাসকদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স করবেন তিনি।