রোগপীড়িত মানুষের কাছে অনেক সময়েই হরেক ওষুধের চেয়ে বেশি কাজ করে ভাল ব্যবহার, সহৃদয় আচরণ। তাই রোগীদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করতে হবে। সরকারি চিকিৎসক, নার্স-সহ সব স্তরের স্বাস্থ্যকর্মীকে আবার এই পরামর্শই দিলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
‘‘চিকিৎসা কখনও বিক্রি হয় না। চিকিৎসা এক ধরনের সেবা। অসুস্থ মানুষ সামনে কোনও ডাক্তার, নার্স বা অন্য স্বাস্থ্যকর্মীকে পেলে ঈশ্বরের দেখা পেয়েছেন বলে মনে করেন। তাঁদের সেই আস্থার মর্যাদা রাখা জরুরি,’’ বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
প্রথিতযশা চিকিৎসকেরা বলে থাকেন, ওষুধের আগেই রোগীর যন্ত্রণা নিরাময়ে কাজ শুরু করে দেয় ডাক্তারের ব্যক্তিত্ব। ঠিকঠাক ওষুধ-পথ্য তো চাই-ই। দ্রুত রোগ নিরাময়ে একই সঙ্গে চাই রোগীর সঙ্গে ডাক্তারের মমতাময় আচরণ। কিন্তু রোগী এবং তাঁদের আত্মীয়স্বজনের অভিযোগ, চিকিৎসাশাস্ত্রের এই গোড়ার কথাটা এখন অনেকাংশে আড়ালে চলে গিয়েছে। অভিযোগটা অনেক চিকিৎসকেরও। ডাক্তারদের একাংশের মধ্য থেকে তাই দাবি উঠছে, শুধু চিকিৎসা-পদ্ধতি শেখালে হবে না। রোগীর সঙ্গে আলাপ আর আচরণের ধরনটাও শেখানো হোক মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের। শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শে এই জরুরি বিষয়টিই গুরুত্ব পেয়েছে।
এ দিন একটি অনুষ্ঠানে রাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালে কর্মরত ৫০ জন কৃতী চিকিৎসক এবং ৫০ জন নার্সকে পুরস্কৃত করল স্বাস্থ্য দফতর। গোড়ায় কোনও আর্থিক পুরস্কারের কথা ছিল না। তবে এ দিন মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশেই স্বাস্থ্যসচিব রাজেন্দ্র শুক্ল জানান, পুরস্কৃত প্রত্যেক ডাক্তারকে ৫০ হাজার এবং নার্সদের মাথাপিছু ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হবে।
এই ধরনের স্বীকৃতির বিষয়টিকে তাঁরা যে শুধু রাজ্য স্তরে সীমাবদ্ধ রাখতে চান না, সেটাও এ দিন স্পষ্ট করে দেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি জানান, পুরস্কারের এই ব্যবস্থা জেলা স্তরেও ছড়িয়ে দেওয়া উচিত। তাতে আরও বেশি যোগ্য চিকিৎসক, নার্স এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীকে স্বীকৃতি দেওয়া সম্ভব হবে।
‘স্বাস্থ্যসাথী’ নামে একটি চিকিৎসা বিমা প্রকল্পেরও উদ্বোধন হল এ দিনের অনুষ্ঠানে। আশা কর্মী, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, স্বনির্ভর গোষ্ঠীর কর্মী এবং চুক্তির ভিত্তিতে নিযুক্ত কর্মীদের মিলিয়ে তিন কোটিরও বেশি মানুষ এই বিমার আওতায় আসছেন। এই প্রকল্পে চিকিৎসার খরচ বাবদ পরিবার-পিছু বছরে দেড় লক্ষ থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা পর্যন্ত পাওয়া যাবে। সরকারি হাসপাতালের সঙ্গে সঙ্গেই পাঁচ শতাধিক বেসরকারি হাসপাতালে এই পরিষেবা দেওয়ার জন্য তাদের নথিভুক্ত করেছে সরকার।
মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, গত কয়েক বছরে রাজ্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা অনেকটাই সম্প্রসারিত হয়েছে। ৪১টি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল গড়ার পরিকল্পনার মধ্যে ৩২টি ইতিমধ্যেই তৈরি। মেডিক্যালে আসন বেড়েছে ১৩৪৫টি। প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব ৬২ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৯২ শতাংশ। প্রতি হাজারে শিশু-মৃত্যুর হার ৩২ থেকে কমে হয়েছে ২৮। তিনি জানান, পরিষেবা সম্প্রসারিত করতে আরও ডাক্তার, আরও নার্স চাই। ১৪ হাজার ডাক্তার ও নার্স নিয়োগ করা হয়েছে। আরও সাত হাজার নিয়োগ করা হবে। ‘‘তবে ডাক্তার তো ঘরে বসে তৈরি হয় না। তার জন্য চাই মেডিক্যাল কলেজ। সে-সবও হচ্ছে। গড়া হচ্ছে আরও পাঁচটি নার্সিং কলেজ,’’ বলেন মমতা।
রাজ্যে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবাকে ‘সেরা’র শিরোপা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজেই। তাঁর কথায়, ‘‘যতই বেসরকারি হাসপাতালে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করা হোক, সরকারি হাসপাতালের পরিষেবা এখনও সেরা।’’ যদিও তাঁর আক্ষেপ, এত কিছুর পরেও সামান্য ত্রুটিবিচ্যুতি ঘটলে সেটা নিয়েই বেশি চর্চা হয়। সরকারি হাসপাতালে যেখানে লক্ষ লক্ষ রোগীর চিকিৎসা হয়, সেখানে সামান্য কিছু ক্ষেত্রে বিচ্যুতিকে বড় করে দেখানো দুর্ভাগ্যজনক বলে মন্তব্য করেন মুখ্যমন্ত্রী।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিশেষ কৃতিত্বের জন্য সুকুমার মুখোপাধ্যায়, সুদর্শন ঘোষদস্তিদার এবং ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায়কে এ দিন সংবর্ধিত করেন মুখ্যমন্ত্রী।