মাঝপথেই থামাচ্ছেন এক শিল্পোদ্যোগীকে। শিল্প-বাণিজ্য মেলায় মুখ্যমন্ত্রী। বৃহস্পতিবার ওমপ্রকাশ সিংহের তোলা ছবি।
জেলার শিল্পপতিদের অভাব-অভিযোগ মেটাতে কোর কমিটি গড়ার কথা ঘোষণা করে দিলেন। জানালেন, নিজেও মাঝেমধ্যে হাজির থাকবেন কমিটির বৈঠকে। কিন্তু যেখানে এই ঘোষণা, সেখানেই ছোট-মাঝারি শিল্পোদ্যোগীদের কথা দু’মিনিটও মন দিয়ে শুনলেন না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়!
বৃহস্পতিবার আসানসোলের পোলো মাঠে শিল্প-বাণিজ্য মেলার উদ্বোধন করেন মুখ্যমন্ত্রী। তার পর বণিকসভার আমন্ত্রণে চা-চক্র। জেলার শিল্পোদ্যোগীরা আশা করেছিলেন এই সুযোগে নিজেদের অভাব-অভিযোগের কথা তুলে ধরবেন প্রশাসনের শীর্ষকর্তার সামনে। শাসক দলের মদতে পুষ্ট সিন্ডিকেট-রাজ থেকে রাজ্য সরকারের ইনস্পেক্টরদের বাড়াবাড়ি— এমন হাজারো সমস্যার প্রতিবিধান চাইবেন। কিন্তু তাঁদের কথা বলতেই দিলেন না মুখ্যমন্ত্রী। থামিয়ে দিলেন মাঝপথে। আধ ঘণ্টার চা-চক্র সেরে মুখ্যমন্ত্রী ফিরে যাওয়ার পরে যা নিয়ে ক্ষোভ উগরে দিলেন বহু শিল্পোদ্যোগী।
সব কথা আমাকে কেন!
শিল্পোদ্যোগীরা তাঁদের সমস্যার কথা বলবেন আঁচ পেয়েই মমতা জানিয়ে দেন, অন্ডালে তাঁর হেলিকপ্টার দাঁড়িয়ে রয়েছে। সন্ধ্যা হয়ে গেলে তা উড়বে না। ফলে খুব বেশি জনের কথা শুনতে পারবেন না। সংক্ষেপে দু’এক জনের বক্তব্য শুনেই বেরিয়ে যাবেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সেই দু’এক জনের কথাতেও মন দিলেন না তিনি।
এক শিল্পোদ্যোগী বলতে শুরু করেছিলেন— “আমার কারখানার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ না পাওয়ায়...।”
থামিয়ে দিয়ে মমতা বলে ওঠেন, “অমিত মিত্রের সঙ্গে কথা বলুন।”
—হ্যাঁ, বলেছি। কিন্তু...
—আঃ, বলছি তো তাঁর সঙ্গে কথা বলতে।
অন্য এক জন বলেন, “রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার তুলনায় ডিভিসি প্রায় অর্ধেক দামে বিদ্যুৎ দেবে। কিন্তু তার জন্য সরকারের নো-অবজেকশন সার্টিফিকেট চাই। দু’বছর ধরে তা চেয়েও পাওয়া যাচ্ছে না।”
—জেলাশাসককে বলুন।
আর এক শিল্পোদ্যোগী বলেন, “সেল্স ট্যাক্স বাবদ সরকারকে দেওয়া টাকার একটা অংশ প্রতি বছর ফেরত পাওয়ার কথা। কিন্তু কয়েক বছর ধরে সেটা পাওয়া যাচ্ছে না...।”
—শিল্পমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন।
বণিকসভার এক সদস্য বলেন, “কারখানা গড়তে জমির চরিত্র বদল করার জন্য অনেকেই আবেদন করেছেন। কিন্তু কাজ হচ্ছে ঢিমে তালে। যদি তাড়াতাড়ি করা যায়...”
—এই হচ্ছে মুশকিল! আপনারা সব কিছু আমাকে বলেন কেন? জেলাশাসককে গিয়ে বলবেন।
আমি কি রক্ষাকর্তা!
“আমার জমি মাফিয়ারা দখল করে নিয়েছে,” মুখ্যমন্ত্রীর কাছে নালিশ করেন বরাকরের এক ব্যবসায়ী। মমতার জবাব, “আপনার জমি আপনি রক্ষা করবেন না তো কি আমি রক্ষা করব? জমি ফাঁকা ফেলে রেখেছেন কেন?”
বিস্মিত শিল্প মহলের প্রশ্ন, জমি-সম্পত্তি বেদখল হয়ে যাওয়া যদি সরকার না-আটকায়, তো আটকাবে কে? খোদ মুখ্যমন্ত্রীর এহেন মন্তব্যের পরে দুষ্কৃতীরা আরও উৎসাহ পেয়ে যাবে বলেও তাদের আশঙ্কা।
আসানসোলে শিল্পপতিদের সঙ্গে বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী। ছবি: শৈলেন সরকার।
মমতা বেরিয়ে যেতেই এক ব্যবসায়ীর মন্তব্য, “এমন বৈঠকে কী লাভ!” বাঁকুড়ার বড়জোড়া থেকে এসেছিলেন প্রবীর সরকার। তাঁর প্যাকেজিংয়ের সামগ্রী তৈরির কারখানার পাশেই এক কয়লা মাফিয়া অবৈধ খাদান খুলে বসেছেন। তাঁর অভিযোগ, প্রশাসনকে জানিয়েও লাভ হয়নি। মুখ্যমন্ত্রীকে হাতের কাছে পেয়েও কিছু জানাতে না-পেরে তিনি রীতিমতো হতাশ। জামুড়িয়ার একটি সংস্থার কর্তা শাসক দলের নিচুতলার কিছু কর্মীর দাদাগিরি-তোলাবাজির কথা জানাবেন ভেবেছিলেন। তাঁর আক্ষেপ, “বলব বলে মাইক হাতে দাঁড়িয়েও পড়েছিলাম। কিন্তু সুযোগ পেলাম কই!” আসানসোল বণিকসভার সভাপতি সুব্রত দত্ত বলেন, “প্রশ্নোত্তর পর্বে শ’দুয়েক শিল্পোদ্যোগী ছিলেন। প্রশ্ন করতে পেরেছেন ১২ থেকে ১৫ জন।”
ফিরিস্তি কিন্তু বিস্তর
চা-চক্রের আগে উদ্বোধনী বক্তৃতায় অবশ্য রীতিমাফিক উন্নয়নের লম্বা তালিকা দিয়ে যান মুখ্যমন্ত্রী। সেখানেই জানান, কলকাতায় যেমন শিল্পপতিদের নিয়ে কোর কমিটি আছে, তেমনই সরকারি কর্তা ও শিল্পপতিদের নিয়ে কমিটি গড়া হবে আসানসোলে। সেখানে তিন থেকে ছ’মাস অন্তর জেলার শিল্পোদ্যোগীদের সঙ্গে বৈঠক করবেন শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্র। মাঝেমাঝে বসবেন তিনি নিজেও। কলকাতার মতো আসানসোলে ‘ইউনিক ক্লিয়ারিং সেন্টার’, দুর্গাপুরে ‘আরবান সিটি’ এবং ‘আইটি ইন্ডাস্ট্রি’ গড়ার কথাও ঘোষণা করেন মমতা।
যা শুনে বাঁকুড়া চেম্বার অব কমার্সের সম্পাদক তথা কনফেডারেশন অব ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের রাজ্য সম্পাদক মধুসূদন দরিপার ক্ষোভ, “অনেক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আমাদের মতো ছোট মাপের উদ্যোগপতিদের গুরুত্ব বাড়ছে না। শুধু মুখের কথায় কিন্তু চিঁড়ে ভেজে না। কাজ করে দেখাতে হয়।”
রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পরে জেলায় জেলায় শিল্প গড়ার ডাক দিয়েছেন মমতা। বলেছেন ছোট ও মাঝারি শিল্পের উপরে জোর দেওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে জেলার শিল্পের সমস্যা নিয়ে সরকার নির্বিকার। সেখানকার শিল্পোদ্যোগীদের অভিযোগ, তাঁদের সমস্যা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী তো দূরস্থান, শিল্পমন্ত্রীর কাছ পর্যন্তও পৌঁছনো যায় না। সরকারের কাছে পাত্তা পায় না বণিকসভাগুলিও। বৃহস্পতিবারের ঘটনাই তার প্রমাণ।
বাবুলের বেলায়
ঘটনাচক্রে, রাজ্যে বিজেপির হাতে থাকা দু’টি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে আসানসোল অন্যতম। ইতিমধ্যে সাংসদ বাবুল সুপ্রিয়কে প্রতিমন্ত্রীও করেছেন নরেন্দ্র মোদী। ভোটে জেতার পরে একাধিক বার, তার পর মন্ত্রী হয়েও রানিগঞ্জ ও আসানসোলে বণিকসভার কর্তাদের নিয়ে বৈঠক করেছেন বাবুল। সেই কথা তুলে রানিগঞ্জের এক ব্যবসায়ী বলেন, “সেই সব বৈঠক সাড়ে চার-পাঁচ ঘণ্টা চলেছিল। আজ তো মুখ্যমন্ত্রী কথা বললেন সাকুল্যে সাড়ে সাত মিনিট!” সব শুনে মুচকি হেসে বাবুল বলেন, “বাঃ, এ তো দারুণ ব্যাপার! শেষমেশ হাফমন্ত্রীর দেখানো পথেই ফুলমন্ত্রীকে (পড়ুন, মুখ্যমন্ত্রী) হাঁটতে হল। ভালই তো!”
সিটুর বর্ধমান জেলা সভাপতি বিনয়েন্দ্রকিশোর চক্রবর্তীর কটাক্ষ, “গত সাড়ে তিন বছরে নতুন শিল্প আসেনি। শাসক দলের তোলাবাজি-সিন্ডিকেটের দাপটে নানা কারখানার কাজ লাটে। সেই সরকারের মুখ্যমন্ত্রীর থেকে এর চেয়ে বেশি আর কী আশা করা যায়!”