বাংলায় বিজেপির নজরদার হিমন্ত বিশ্ব শর্মা। — ফাইল চিত্র।
বিধানসভা নির্বাচনের ‘ভুল’ লোকসভা নির্বাচনে আর নয়। অন্তত বাংলার ক্ষেত্রে এটাই বিজেপির নীতি। গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে ঝাঁকে ঝাঁকে তৃণমূলের নেতা, বিধায়ক, মন্ত্রী এবং এক সাংসদও বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁদের অধিকাংশই টিকিট পেয়েছিলেন। আবার অভিনয় জগতের অনেককে দলে টেনে প্রার্থী করা হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে খড়্গপুর সদরে হিরণ চট্টোপাধ্যায় ছাড়া কেউই জিততে পারেননি। সেই সব ‘যোগদান মেলা’-র নেতৃত্বে ছিলেন মুকুল রায়। যিনি এখন বিজেপির বিধায়ক হলেও বিজেপিতে নন। মুকুলের সিদ্ধান্তে সিলমোহর দেওয়ার জন্য ছিলেন রাজ্যের জন্য নিযুক্ত কেন্দ্রীয় বিজেপির পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয়। তিনি এখন মধ্যপ্রদেশের মন্ত্রী। এ বার মুকুল-কৈলাস জুটির ‘কাজ’ দেখতে পারেন অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। কেন্দ্রীয় বিজেপির একটি সূত্র তেমনই জানাচ্ছে।
সম্প্রতি বিজেপি দলের সমস্ত সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদককে আলাদা আলাদা দায়িত্ব দিয়েছে। তবে তেমন কোনও দায়িত্ব কৈলাস পেয়েছেন বলে শোনা যায়নি। তার বদলে তুলনায় কম গুরুত্বের দায়িত্ব সহ-সভাপতি পদে থাকা বৈজয়ন্ত জয় পণ্ডাকে আনা হয়েছে ওই দলে। বাংলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সুনীল বনসলকে বাংলার পাশাপাশিই দেখতে হবে ওড়িশা এবং তেলেঙ্গানার সংগঠনও। বিজেপিতে আপাতত সব চেয়ে কুশলী নেতা হিসাবে পরিচিত সুনীলের হাতে রয়েছে দলের সর্বাধিক শক্তিশালী মোর্চার সর্বভারতীয় পর্যবেক্ষকের দায়িত্বও। প্রসঙ্গত, যুব মোর্চার মাধ্যমেই নতুন এবং যুব ভোটারদের পদ্ম-অনুরাগী বানাতে চায় বিজেপি। আগামী ২৫ জানুয়ারি মোদী ‘নব মতদাতা সম্মেলন’ করতে চলেছেন। এই পরিস্থিতিতে বাংলায় অন্য দল থেকে নেতা বা মন্ত্রী নেওয়ার দায়িত্ব পুরোপুরি সুনীলের কাঁধে না চাপিয়ে হিমন্তকে দেওয়া হয়েছে বলেই খবর।
গত শনিবারই হিমন্তের সঙ্গে কলকাতায় বৈঠক হয় সুকান্তদের। — নিজস্ব চিত্র।
কেন্দ্রীয় বিজেপি লোকসভা ভোটের জন্য যে মূল দল বানিয়েছে, তাতে অপেক্ষাকৃত ছোট অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি মোর্চার দায়িত্বে রয়েছেন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক বিনোদ তাওড়ে। এরই সঙ্গে গোটা দেশে অন্য দলের নেতাদের যোগদানেরও যে কমিটি তৈরি হয়েছে, তার প্রধান করা হয়েছে মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী তাওড়েকে। সেই কমিটিতেই রয়েছেন হিমন্ত। প্রসঙ্গত, অসমের মুখ্যমন্ত্রী হলেও বিজেপি জাতীয় রাজনীতিতেও হিমন্তকে সবিশেষ গুরুত্ব দেয়।
তবে এমন কমিটি বা তার দায়িত্বে হিমন্ত রয়েছেন কি না, সে প্রশ্নে রাজ্য বিজেপির নেতারা চুপ। ঘটনাচক্রে, গত রবিবার সন্ধ্যাতেই কয়েক ঘণ্টার জন্য কলকাতায় এসেছিলেন হিমন্ত। বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার, সাধারণ সম্পাদক জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় এবং তৃণমূল থেকে বিজেপিতে আসা বিষ্ণুপুরের সাংসদ সৌমিত্র খাঁ। বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে, রবিবারই রাজ্যের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক করেছেন হিমন্ত। মঙ্গলবারও তৃণমূল থেকেই বিজেপিতে এসে সাংসদ এবং কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী হওয়া নিশীথ অধিকারীর সঙ্গে বৈঠক হয়েছে হিমন্তের। তবে কী বিষয়ে বৈঠক, তা নিয়ে কোনও পক্ষ মুখ খোলেনি।
মঙ্গলবার বৈঠক করেন হিমন্ত বিশ্বশর্মা এবং নিশীথ প্রামাণিক। — নিজস্ব চিত্র।
একটা সময়ে অন্য দলের নেতাদের কাছে টানার বিষয়ে বিজেপির অনেক ছুঁতমার্গ ছিল। কিন্তু এখন আর তা নেই। হিমন্তই দীর্ঘ দিন কংগ্রেসের মন্ত্রী থাকার পরে ২০১৫ সালে বিজেপিতে যোগ দেন। সর্বানন্দ সোনওয়ালের মন্ত্রিসভায় জায়গা পেয়ে যান এক বছরের মধ্যেই। এখন তিনিই মুখ্যমন্ত্রী। সেই সঙ্গে উত্তর-পূর্ব ভারতে বিজেপির সংগঠনও মূলত তিনিই দেখেন। প্রসঙ্গত, মোদী মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা জ্যোতিরাদিত্য শিন্ডে কিংবা নারায়ণ রাণেও অন্য দল থেকে বিজেপিতে এসেছেন। লালুপ্রসাদ যাদবের আরজেডি থেকে বিজেপিতে এসে বিহারের রাজ্য সভাপতি হয়েছেন সম্রাট চৌধুরীও।
বাংলায় অনেকেই দল বদলে বিজেপির সাংসদ বা বিধায়ক হয়েছেন। সবচেয়ে বড় উদাহরণ শুভেন্দু অধিকারী। বিজেপিতে যোগ দেওয়ার সাড়ে চার মাসের মাথায় তিনি বিজেপির পরিষদীয় নেতা তথা বিরোধী দলনেতা হয়েছিলেন। এখন তিনিই রাজ্যে দলের অন্যতম ‘মুখ’। গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির ‘যোগদান মেলা’ পরিচালনায় অল্প দিনের মধ্যে তাঁরও বড় ভূমিকা ছিল। শুভেন্দু বিজেপিতে এসেছিলেন ১১ জন বিধায়ক এবং সাংসদকে নিয়ে। পরে চার্টার্ড উড়ানে দিল্লিতে বিভিন্ন নেতাদের যোগদানের জন্য পাঠানোতেও বড় ভূমিকা ছিল তাঁর। তবে সেই দলবদলুদের সফরসঙ্গী হয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মুকুল-কৈলাস।
তেমন ‘তারকা’ যোগদান না হলেও এ বারেও যে রাজ্য বিজেপি ‘যোগদান মেলা’ করবে, তা আগেই জানিয়েছেন সুকান্ত। তবে তিনি চান, নীচু স্তরের কর্মীরা দলে আসুন। কেন্দ্রীয় বিজেপি অবশ্য এ বার রাজ্য থেকে বড় সংখ্যায় আসন পাওয়ার লক্ষ্যে ‘নবাগত’ মুখও চায়। যদিও চাপ বিধানসভা নির্বাচনের থেকে কম। ২৯৪ আসনে প্রার্থী দিতে বিজেপিকে যত সংখ্যায় নেতা ‘ধার’ করতে হয়েছিল, ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে অবস্থা তেমন নয়। হাতে রয়েছেন ১৬ সাংসদ। কাঁথি, তমলুক, আরামবাগ, মালদহ দক্ষিণের মতো আসনে ‘সহজ জয়’ মিলবে বলে আশাবাদী বিজেপি। এর পরেও কিছু আসন জিততে হলে অন্য দল থেকে এলাকা অনুযায়ী ‘প্রভাবী’ নেতাকে প্রার্থী করার পরিকল্পনা রয়েছে বিজেপির। কোথাও কোথাও ‘তারকা’দেরও। কিন্তু এই যোগদানে যাতে হঠকারী সিদ্ধান্তের পরিবর্তে সুচিন্তিত পদক্ষেপ হয়, সেটাই নিশ্চিত করতে চাইছে কেন্দ্রীয় বিজেপি। আর তার জন্য গোটা দেশে বিনোদ আর বাংলা এবং ওড়িশায় বাড়তি নজর দেবেন হিমন্ত। রাজ্য নেতৃত্ব ও কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে তিনিই সেতুর কাজ করবেন।