টুইটারে মমতা লিখেছেন, ‘‘পরিবর্তনের পক্ষে যে জনাদেশ দিয়েছেন কর্নাটকবাসী, সে জন্য তাঁদের কুর্নিশ জানাই।’’ — ফাইল ছবি।
কর্নাটকে যাঁরা বিজেপিকে হারালেন, তাঁদের কুর্নিশ জানালেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে সেই কন্নড় জনতা বিজেপিকে হারিয়ে যাদের জেতালেন, সেই কংগ্রেসের নামও নিলেন না তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী। কর্নাটকের বিধানসভা ভোটে বড়সড় ব্যবধানে জিতছে কংগ্রেস। সেই ফলাফল স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পরেই টুইট করেন মমতা।
টুইটারে মমতা লিখেছেন, ‘‘পরিবর্তনের পক্ষে যে জনাদেশ দিয়েছেন কর্নাটকবাসী, সে জন্য তাঁদের কুর্নিশ জানাই।’’ তার পরেই তিনি নাম না করে একহাত নিয়েছেন বিজেপিকে। মমতা লিখেছেন, ‘‘নৃশংস স্বৈরাচার এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের রাজনীতি পরাজিত! যখন মানুষ বহুত্ববাদ এবং গণতান্ত্রিক শক্তির জয় চায়, তখন কোনও কেন্দ্রীয় শক্তি তাদের স্বতঃস্ফূর্ততাকে দমিয়ে রাখতে পারে না। এটাই গল্পের সারমর্ম।’’ এই হার যে ‘আগামী দিনের জন্য শিক্ষা’, সে কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন মমতা।
মমতা যেমন তাঁর টুইটে কোথাও বিজেপির নামোল্লেখ করেননি, তেমনই জয়ী কংগ্রেসেরও নাম নেননি। জয়ীকে শুভেচ্ছা জানানোর পথেও হাঁটেননি। মমতার টুইট থেকে এটা স্পষ্ট যে, কংগ্রেসের জয়ের চেয়েও তিনি বিজেপির বিশাল পরাজয়কে বেশি গুরুত্ব দিতে চেয়েছেন। ‘মা-মাটি-মানুষ’-এর সরকারের মুখ্যমন্ত্রী কুর্নিশ জানিয়েছেন সাধারণ মানুষকে। অর্থাৎ, কর্নাটকবাসীকে। লিখেছেন, পরিবর্তনের পক্ষে তাঁরা যে জনাদেশ দিয়েছেন, সে কারণে তাঁদের কুর্নিশ।
মমতা শনিবার বিকেলে বলেন, ‘‘আমি যেটা মনে করি অহঙ্কার, দুর্বিষহ ব্যবহার, এজেন্সি রাজনীতি, নৃশংসতার বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে মানুষ। ভোট টু নো বিজেপি। কুর্নিশ জানাই কর্নাটকের মানুষদের। বিজয়ীদের। ছত্তীসগঢ়, মধ্যপ্রদেশ নির্বাচন আসছে। সেখানেও বিজেপি হারবে। শেষের শুরু।’’ কেন্দ্রীয় সংস্থার তৎপরতা নিয়েও ফের কটাক্ষ করেছেন মমতা। তিনি বলেন, ‘‘বিজেপির জমানায় সকলে কেন্দ্রীয় সংস্থার মুখোমুখি হচ্ছেন। বিভিন্ন বিষয়ে নিম্ন আদালত, হাই কোর্টের হস্তক্ষেপ বাড়ছে।’’ মমতা এ-ও জানালেন, বাংলা যে পথ দেখিয়েছিল, সেই পথেই আজ কর্নাটকও। তাঁর কথায়, ‘‘বিজেপি সকলকেই এ ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। স্বার্থ চরিতার্থ করার রাজনীতি চলছে। বাংলা যে পথ দেখিয়েছে, বাংলা থেকে বেঙ্গালুরু আজ সেই পথেই।’’
কর্নাটকে কংগ্রেসের এই বড়সড় জয়ের পরে স্বভাবতই জাতীয় রাজনীতিতে বিজেপির ‘বিকল্প’ শক্তি হিসাবে কংগ্রেসের গুরুত্ব অনেকটাই বেড়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে তৃণমূল বা আম আদমি পার্টির মতো দলগুলির গুরুত্ব ততটা না থাকারই সম্ভাবনা। বিজেপি বিরোধী জোট গঠনে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রেও কংগ্রেস এগিয়ে যাবে। সম্ভবত সেই কারণেই তৃণমূল নেত্রী কংগ্রেসের জয়কে তত গুরুত্ব না দিয়ে বিজেপির হারকেই বড় করে দেখাতে চেয়েছেন।
২০২৪ লোকসভা ভোটকে নজরে রেখে বিরোধী ঐক্যের উপর জোর দিয়েছেন মমতা। ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে জয়ের পর থেকেই বিরোধী জোটের উপর গুরুত্ব দিতে শুরু করেছিলেন তিনি। দিল্লিতে গিয়ে বিজেপি বিরোধী নেতাদের সঙ্গে কথাও বলেছিলেন। তখন কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গেও দেখা করেছিলেন তৃণমূল নেত্রী। কিন্তু দিন যত এগোয়, কংগ্রেসের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে মমতার। সেই দূরত্ব লড়াইয়ে পর্যবসিত হয় গোয়া বিধানসভা নির্বাচনে। গত বছর ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে মমতা জানান, ২০২৪ সালের লোকসভায় যে যেখানে ‘শক্তিশালী’, তাকে সেখানে জায়গা ছাড়তে হবে। ভোটের আগে নয়, ভোটের পরে বিজেপিকে সরাতে জোট হবে। মমতার ওই বক্তব্যে কংগ্রেস মনে করেছিল, রাহুল বা কংগ্রেসের নেতৃত্ব মেনে নিতে চাইছেন না মমতা।
বস্তুত, মমতার সঙ্গে কংগ্রেসের সম্পর্ক ইদানীং কালে যে খুব ‘মসৃণ’ থেকেছে, তা নয়। উত্তর-পূর্বে ভোটের প্রচারে গিয়ে রাহুল পশ্চিমবঙ্গের প্রসঙ্গ তুলে তৃণমূলকে সরাসরি আক্রমণ করেছেন। মমতা তো বটেই, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও কংগ্রেসকে কড়া ভাষায় আক্রমণ করেছেন।
রাহুলের সাংসদ পদ খারিজ হওয়ার পরে অবশ্য রাহুলের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন মমতা। তার পরে গত মার্চে ধর্মতলায় ধর্নামঞ্চ থেকে মমতা ফের বিরোধী জোট নিয়ে সরব হন। সেখান থেকে তিনি জানিয়েছিলেন, সব বিরোধী দলকে একসঙ্গে লড়তে হবে। বিজেপিকে গদি থেকে হটাতে হবে। কিন্তু সেই জোটে কংগ্রেসের কী ভূমিকা হবে, তা নিয়ে কোনও দিনই সে ভাবে মুখ খোলেননি মমতা। তবে বিরোধীদের তরফে বলা হয়েছে, কংগ্রেসের ‘দাদাগিরি’ চলবে না। মমতা নিজে জোট গড়তে তৎপর হয়েছেন। গত কয়েক মাসে তাঁর সঙ্গে একে একে দেখা করেছেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার, উপমুখ্যমন্ত্রী তেজস্বী যাদব, জেডিএস নেতা এইচডি কুমারস্বামী। দেখা হয়েছে সমাজবাদী পার্টির শীর্ষনেতা তথা উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবের সঙ্গেও। মমতা নিজে ওড়িশায় গিয়ে দেখা করেন মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়কের সঙ্গে। কিন্তু কংগ্রেসের কেউ মমতার সঙ্গে বৈঠক বা সাক্ষাতের তালিকায় ছিলেন না। যা থেকে স্পষ্ট, বিজেপি বিরোধিতার ‘বৈধতা’র প্রশ্নে মমতা কংগ্রেসকে জায়গা ছেড়ে দিতে রাজি নন। বস্তুত, মমতা এবং অভিষেকের একমুখী প্রচারই হল— বিজেপিকে হারাতে পারে একমাত্র তৃণমূল। তৃণমূলই বিজেপির একমাত্র এবং আসল ‘বিকল্প’। সেই সূত্রেই কংগ্রেসের থেকে বরাবর দূরত্ব রেখে চলেছেন মমতা। বিভিন্ন সময়ে কংগ্রেসকে আক্রমণও করেছেন। সম্প্রতি সাগরদিঘি উপনির্বাচনে কংগ্রেসের কাছে হারের পর মমতা ‘একলা চলো’ নীতির কথা ঘোষণা করেছিলেন। বলেছিলেন, তৃণমূলের জোট হবে একমাত্র মানুষের সঙ্গে। কিন্তু তার কিছু দিন পর থেকে তিনি আবার জোট নিয়ে সরব হয়েছেন। যদিও এই দফাতেও তাঁর মুখে কংগ্রেসের নাম শোনা যায়নি।
উত্তরপ্রদেশে অখিলেশ যাদবের দল সমাজবাদী পার্টির হয়ে প্রচারে গিয়ে সরাসরি রাহুল এবং প্রিয়ঙ্কাকে কটাক্ষ করেছিলেন মমতা। ‘বসন্তের কোকিল’ বলেছিলেন তাঁদের। আবার সম্প্রতি মেঘালয়ে বিধানসভা ভোটের প্রচারে গিয়ে তৃণমূলের ‘ইতিহাস’ নিয়ে কটাক্ষ করেছিলেন রাহুলও। তারই পাল্টা তৃণমূল নিজেদের ‘বিজেপির বিকল্প’ হিসাবে প্রচার শুরু করে।
কর্নাটকে কংগ্রেসের বিরাট জয়ের পর বিজেপি বিরোধিতায় ‘নেতৃত্ব’ দেওয়ার প্রশ্ন পরিস্থিতির যে খানিকটা পরিবর্তন হবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। বিশেষত, চলতি বছরে আরও চারটি রাজ্যের বিধানসভা ভোটে কংগ্রেস যে খানিকটা এগিয়ে থেকে লড়াই শুরু করবে, তাতেও কোনও সন্দেহ নেই। সেই পরিস্থিতিতে কংগ্রেসের নাম না-করে মমতার শনিবারের টুইটটি আরও ‘তাৎপর্যবহ’।