আগাম ঘোষণা ছিল। জানানো ছিল রাজ্য পুলিশকেও। তা সত্ত্বেও বেআইনি হকারদের দখলদারি থেকে স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম মুক্ত করতে পারলেন না রেল কর্তৃপক্ষ। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানোর ন্যূনতম স্বাচ্ছন্দ্য থেকেও বঞ্চিত হলেন যাত্রীরা।
প্ল্যাটফর্ম থেকে অবৈধ হকারদের উচ্ছেদ অভিযানকে কেন্দ্র করে রেল কর্তৃপক্ষ ও হকারদের মধ্যে শনিবার সকাল থেকে সংঘর্ষে কার্যত রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় বারুইপুর স্টেশন। যাত্রীদের লক্ষ করে পাথর ছোড়া ও বোমা পড়ার অভিযোগ ওঠে, হকারদের হাতে প্রহৃত হন রেলের উচ্চপদস্থ আধিকারিক। রেল চলাচলেও ব্যাঘাত ঘটে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে হতে দুপুর গড়িয়ে যায়। চূড়ান্ত নাকাল হতে হয় সাধারণ যাত্রীদের। প্রবল বিক্ষোভের মুখে পড়ে আপাতত ওই স্টেশনে হকার উচ্ছেদ অভিযান স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন রেল কর্তৃপক্ষ।
রেল সূত্রে জানানো হয়েছে, শিয়ালদহ মেন লাইন, বনগাঁ এবং দক্ষিণ শাখার বিভিন্ন স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে বেআইনি দোকানের জেরে যাত্রীদের দাঁড়ানোর জায়গা নেই। বার বার যাত্রীরা এই অভিযোগ জানাচ্ছিলেন রেল কর্তৃপক্ষের কাছে। এই অভিযোগের নিরিখেই রেলের তরফ থেকে বালিগঞ্জ, ডায়মন্ড হারবার সমেত বিভিন্ন স্টেশনে কয়েক দিন ধরেই হকার উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়। এ দিন বারুইপুরে সেই অভিযান চালাতে গিয়েই তীব্র সমস্যায় পড়েন রেলকর্মীরা।
রেল কর্তৃপক্ষ এবং রাজ্য সরকার পরস্পরের উপরে এই ঘটনার দায় চাপাচ্ছেন। শনিবারের ঘটনার পরে রেল কর্তৃপক্ষ জানান, রাজ্য সরকারের সম্পূর্ণ সহযোগিতা না পেলে যাত্রীদের সমস্যার সমাধান তাঁরা করতে পারবেন না। অন্য দিকে, রাজ্য পুলিশের অতিরিক্ত ডিরেক্টর জেনারেল (আইনশৃঙ্খলা) অনুজ শর্মা এ দিন নবান্নে বলেন, ‘‘বারুইপুর স্টেশনে হকার উচ্ছেদ করার জন্য রেল আমাদের সহযোগিতা চেয়ে আর্জি জানিয়েছিল। আমরা বলেছিলাম, উচ্ছেদ করতে গেলে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে। তাই এখন উচ্ছেদ অভিযান করবেন না। কিন্তু ওঁরা এ দিন সকালে স্টেশনে উপস্থিত হন ও গোলমাল শুরু হয়। এই ঘটনাটি নিয়ে রেলের উচ্চপদস্থ কর্তাদের সঙ্গে রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব বৈঠক করবেন।’’
কী হয়েছিল এ দিন?
পুলিশ সূত্রে খবর, এ দিন সকাল সাড়ে ৮টা নাগাদ বারুইপুর স্টেশনে হকার উচ্ছেদ অভিযানের জন্য রেলকর্মীরা এবং রেলপুলিশের একাংশ উপস্থিত হতেই প্রায় দেড় হাজার হকার তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনের পতাকা হাতে নিয়ে উচ্ছেদ অভিযান বিরোধী মিছিল শুরু করেন। বারুইপুর স্টেশনের চারটি প্ল্যাটফর্ম ঘুরে ঘুরে চলতে থাকে মিছিল। বিক্ষোভ মিছিলের নেতৃত্ব দেন বারুইপুর পুরসভার ১২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর গৌতম দাস। তিনি বলেন, ‘‘হকার উচ্ছেদ চলবে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গরিবের ওপর অত্যাচার মানবেন না। এই অভিযান বন্ধের জন্য বিধায়ককে বলা হয়েছে। যাঁরা হকারদের উচ্ছেদ করতে এসেছেন নিজেদের ভাল চাইলে চলে যান।’’ হকারদের বিক্ষোভের জেরে এ দিন উচ্ছেদ অভিযানের কাজ শুরু করতেই পারেনি রেল কর্তৃপক্ষ।
স্টেশনে উপস্থিত যাত্রীদের একাংশের অভিযোগ, বিক্ষোভকারীরা স্টেশনের টিকিট কাউন্টারের সামনে প্রায় ৮-১০টি বোমা ফাটায়। বিক্ষোভকারীরা তাঁদের দিকে পাথর ছোড়ে। ঘটনার জেরে স্টেশনে উপস্থিত যাত্রীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। অনুজ শর্মা অবশ্য বোমাবাজি সম্পর্কে বলেন, ‘‘রিপোর্ট না এলে বোমা ফেটেছে কি না বলা যাচ্ছে না।’’
এই ঘটনার জেরে ব্যহত হয় ট্রেন চলাচল। বিক্ষোভের জেরে শিয়ালদহ-বারুইপুর শাখার ট্রেনগুলির গতি ধীর হয়ে যায়। ঘটনাস্থলে উপস্থিত রেলের সেকশন ইঞ্জিনিয়ার কমল ঘোষকে মারধর করেন বিক্ষোভকারীরা। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে বিআরসিংহ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
রেল কর্তৃপক্ষ জানান, শনিবারের অভিযান ছিল পূর্ব পরিকল্পিত। গত দু’দিন ধরে রেলের তরফ থেকে বারুইপুর স্টেশনে মাইকে উচ্ছেদ অভিযানের কথা ঘোষণা করা হয়েছিল, ঠিক যে ভাবে বালিগঞ্জ কিংবা ডায়মন্ড হারবারে জানানো হয়েছিল। বালিগঞ্জ ও ডায়মন্ড হারবারে সমস্যা না হলেও এ দিন বারুইপুরে অভিযানে গিয়ে সমস্যায় পড়লেন রেল কর্তৃপক্ষ।
এই ঘটনা প্রসঙ্গে শিয়ালদহ রেল পুলিশ সুপার দেবাশিস বেজ বলেন, ‘‘রেল কর্তৃপক্ষ ও রেলওয়ে প্রোটেকশন ফোর্সের যৌথ উদ্যোগে এ দিন হকার উচ্ছেদ অভিযান চালাতে গিয়ে বারুইপুরে এত সমস্যা হল। গভর্নমেন্ট রেলওয়ে পুলিশ (জিআরপি) এই অভিযানে সামিল হবে না। তবে, আইনশৃঙ্খলার বিষয়ে আমরা নজর রাখছি।’’ দেবাশিসবাবুর এই বক্তব্য শুনে পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক রবি মহাপাত্র বলেন, ‘‘হকার উচ্ছেদ অভিযান করতে গেলে আইনশৃঙ্খলার সমস্যা হতেই পারে। তাই জিআরপিকে অভিযানে থাকতেই হবে। কারণ, আইনশৃঙ্খলা দেখার দায়িত্ব তাদের। জিআরপি যদি সহযোগিতা না করে তা হলে অভিযান বন্ধ রাখতে হবে।’’
হকার উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ রাখলে যাত্রীদের সমস্যার সমাধান হবে কী ভাবে?
রবি মহাপাত্র বলেন, ‘‘যাত্রীদের অভিযোগ পেয়েই আমরা এগিয়েছিলাম। কিন্তু রাজ্য সরকারের সহযোগিতা না পেলে এই কাজ করা সম্ভব নয়।’’
বিক্ষোভকারীদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এ দিন বৈঠকে বসেন রেলকর্তৃপক্ষ। যদিও কোনও রফাসূত্র বের হয়নি। শনিবার বিকেলে রেলের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, রাজ্য সরকারের পর্যাপ্ত সহযোগিতা না পাওয়া পর্যন্ত আপাতত উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ রাখা হল।
আরও পড়ুন: যুদ্ধের পর শান্ত মথুরা, হাসি ফুটল প্রতিবেশীদের মুখে