হল না পরীক্ষা। বাড়ির পথে প্রার্থীরা। সিউড়ির একটি বেসরকারি পলিটেকনিক কলেজের কাছে। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়
আইটিআই-এর প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের পিছনে ষড়যন্ত্র দেখছেন রাজ্যের কারিগরি শিক্ষামন্ত্রী। আঙুল তুলছেন সিপিএমের দিকে। আর মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা, ওই প্রশ্নপত্র বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার পিছনে কে বা কারা আছে, সিআইডি তার তদন্ত করবে।
পরীক্ষা শুরু হতে তখন বাকি মাত্রই কয়েক ঘণ্টা। তত ক্ষণে অনেক পরীক্ষা কেন্দ্রেই ছাত্রছাত্রীরা হাজির হয়ে গিয়েছেন। পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছনোর জন্য কোনও কোনও প্রার্থী উঠে পড়েছেন গাড়িতে বা বাসে। কেউ কেউ আছেন মাঝপথে।
রবিবার সকালে এমনই তুঙ্গ মুহূর্তে কারিগরি শিক্ষা দফতরের কর্তারা টের পেলেন, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে গিয়েছে! তড়িঘড়ি বাতিল করে দেওয়া হল ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট বা আইটিআই-এর প্রবেশিকা পরীক্ষা। রাজ্য জুড়ে নাকাল হলেন প্রায় সওয়া এক লক্ষ পরীক্ষার্থী। কারিগরি শিক্ষা দফতরের কর্তাদের দাবি, পরীক্ষা পদ্ধতি স্বচ্ছ রাখতেই এই পদক্ষেপ। পরীক্ষা বাতিলের খবর এসএমএস করে পরীক্ষার্থীদের জানানো হয়েছে। পরীক্ষা দিতে না-পেরে অনেকেই ক্ষোভ উগরে দেন। ভাঙচুরও হয়েছে কয়েকটি জায়গায়।
কারিগরি শিক্ষামন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাস জানান, নতুন প্রশ্নপত্র তৈরি করে ৫ জুলাই এই পরীক্ষা নেওয়া হবে। এবং পুরনো অ্যাডমিট কার্ড দেখিয়ে একই পরীক্ষা কেন্দ্রে পরীক্ষা দেওয়া যাবে।
কী ভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস হল, এই প্রশ্ন তো উঠছেই। সেই সঙ্গে এই প্রশ্নটাও বড় হয়ে উঠছে যে, প্রশ্নপত্র ফাঁসের কথা জানতে দফতরের কর্তাদের এত দেরি হল কেন?
সদুত্তর দিতে পারেননি কারিগরি শিক্ষা দফতরের কর্তারা। তদন্ত শুরু হয়েছে বলে দাবি করে দফতরের এক শীর্ষ কর্তার ইঙ্গিত, উপর মহলের যোগসাজশ ছাড়া প্রশ্ন ফাঁস হতে পারে না। কিন্তু তদন্তে উপর মহলের যোগসাজশের প্রসঙ্গটি খতিয়ে দেখা হবে কি না, তা নিয়ে দফতরের অনেক কর্তাই সন্দিহান। তবে একটি সূত্র বলছে, নদিয়া জেলা থেকেই প্রথম প্রশ্ন ফাঁসের খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। দফতরের মন্ত্রী ওই জেলারই বিধায়ক। এই তথ্যটা দফতরের অন্দরের অস্বস্তি বাড়িয়ে দিয়েছে।
কী বলছেন কারিগরি শিক্ষামন্ত্রী?
উজ্জ্বলবাবুর বক্তব্য, সিপিএমের দলীয় মুখপত্রেই প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি বেরিয়েছে। এবং সেই খবরে প্রকাশিত প্রশ্নপত্রের সঙ্গে দফতরের প্রশ্নপত্র পুরোটাই মিলে গিয়েছে। তাই যে-সব কর্মী রাজনৈতিক ভাবে ওই দলীয় সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত, তাঁরাই এ কাজ করেছেন বলে মন্ত্রীর অভিযোগ।
কী ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার?
‘‘কারিগরি প্রশিক্ষণ ও বৃত্তিশিক্ষার অধিকর্তা এবং দফতরের যুগ্মসচিবকে নিয়ে তদন্ত কমিটি গড়া হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে রিপোর্ট পাওয়া যাবে,’’ বলছেন মন্ত্রী। তাঁর ঘনিষ্ঠ একটি মহল জানাচ্ছে, মন্ত্রী সন্দেহের তালিকায় রাখছেন নিজের দফতরের কর্মীদের একাংশকেও। এই নিয়ে দিনভর তোলপাড়ের পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই রাতে সিআইডি-কে ওই প্রশ্ন ফাঁসের তদন্ত করার নির্দেশ দেন।
কী ভাবে তৈরি ও বিলি করা হয় আইটিআই প্রবেশিকার প্রশ্নপত্র?
কারিগরি শিক্ষা দফতর জানাচ্ছে, ওই প্রশ্নপত্র ছাপানো হয় সরস্বতী প্রেসে। সেখানে চার সেট প্রশ্ন দেওয়া হয়। কোন সেট ছাপাতে হবে, সেটা জানানো হয় একেবারে শেষ মুহূর্তে। সেই অনুযায়ী প্রশ্নপত্র ছাপিয়ে তা তুলে দেওয়া হয় দফতরের হাতে। সেখান থেকে সেগুলো যায় বিভিন্ন থানায়। পরীক্ষার দিন দফতরের কর্মীরা তা পৌঁছে দেন পরীক্ষা কেন্দ্রে। মন্ত্রীর দাবি, পুরো প্রক্রিয়া যে-ভাবে পরিচালিত হয়, তাতে ষড়যন্ত্র ছাড়া প্রশ্নপত্র বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় থাকেই না। আর বৃত্তিশিক্ষা সংসদের সভাপতি রুদ্রনীল ঘোষের মন্তব্য, ‘‘অনভিপ্রেত ঘটনা। এই ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দফতরকে সাবধান হতে হবে।’’
আচমকা পরীক্ষা বাতিল হয়ে যাওয়ায় এ দিন বিভিন্ন জেলা থেকে বিক্ষোভ ও গোলমালের খবর এসেছে। নদিয়ার কল্যাণীতে একটি বেসরকারি স্কুলে শিক্ষিকা ও কর্মীদের গালিগালাজ ও ভাঙচুরের অভিযোগ উঠেছে। সেখানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। হুগলির খবর, এক দল পরীক্ষার্থী চুঁচুড়ার সুকান্তনগর বিদ্যালয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন। কেউ কেউ পরীক্ষা কেন্দ্রের ঘরে বসেও পড়েন। তখনই আসে পরীক্ষা বাতিলের খবর। সুমন মাঝি নামে এক পরীক্ষার্থী বলেন, ‘‘আমরা স্কুলে বসে বইয়ে চোখ বোলাচ্ছিলাম। তখনই খবর পেলাম, প্রশ্ন ফাঁস হয়ে গিয়েছে। তাই পরীক্ষা বন্ধ।’’ চুঁচুড়ারই জ্যোতিষচন্দ্র বিদ্যাপীঠে পরীক্ষা দিতে আসা গুড়াপের অমল সরকার বলেন, ‘‘কর্তব্যে গাফিলতির জন্য প্রশ্নপত্র ফাঁস হল। আর তার ফল ভুগতে হচ্ছে আমাদের!’’ পরীক্ষা বাতিল হওয়ায় দুর্গাপুর ও আসানসোলের বিভিন্ন স্কুলেও ছাত্রছাত্রীরা বিক্ষোভ দেখান।
পরীক্ষার্থীরা বিক্ষোভ দেখিয়েছেন উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলাতেও। রায়গঞ্জের সুদর্শনপুর দ্বারিকাপ্রসাদ উচ্চ বিদ্যাচক্র হাইস্কুলে ক্ষোভে ফেটে পড়েন প্রার্থীদের একাংশ। পুলিশের উপস্থিতিতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। কাউন্সিলের অনুরোধে এর পরে পুলিশ সব স্কুল থেকে প্রশ্নপত্র তুলে নিয়ে রায়গঞ্জ থানায় পৌঁছে দেয়।
আইটিআই প্রবেশিকার এক প্রার্থীর অ্যাডমিট কার্ডে বিভ্রাটকে ঘিরে নিয়ে শনিবারেই এক দফা শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। পশ্চিম মেদিনীপুরের গোয়ালতোড়ে জিরাপাড়া পঞ্চায়েত এলাকার বাসিন্দা সৌম্যদীপ মাহাতোর অ্যাডমিট কার্ডে ওই পরীক্ষার্থীর বদলে একটি কুকুরের ছবি ছিল। তা নিয়ে তোলপাড়ের মধ্যে কারিগরি শিক্ষা দফতর জানায়, ওই অ্যাডমিট কার্ড নিয়েই পরীক্ষা দিতে পারবেন সৌম্যদীপ। এ দিন কী বলছেন তিনি?
সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ দুই বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে ঝাড়গ্রামের ননীবালা বয়েজ হাইস্কুলের পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছে গিয়েছিলেন সৌম্যদীপ। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যাওয়ায় পরীক্ষা বাতিল হয়ে গিয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘এই রকম আজব অ্যাডমিট কার্ড নিয়ে যাতে কোনও সমস্যা না-হয়, সেই জন্য তাড়াতাড়ি পরীক্ষা কেন্দ্রে চলে এসেছিলাম। কিন্তু পরীক্ষাটাই তো বাতিল হয়ে গেল!’’
মোবাইলে টোকাটুকি
আইটিআই প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে তোলপাড় চলছিল সকাল থেকেই। তারই মধ্যে রবিবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা ইউজিসি-র পরীক্ষা ‘নেট’ চলাকালীন হোয়াটসঅ্যাপে প্রশ্নপত্র বাইরে পাঠানোর অভিযোগে এক যুবককে গ্রেফতার করা হল প্রিটোরিয়া স্ট্রিটের একটি স্কুলে। বেলা সওয়া ২টো নাগাদ ওই স্কুলের অধ্যক্ষা শ্রাবণী সামন্ত লক্ষ করেন, এক পরীক্ষার্থী হলে বসেই মোবাইল ব্যবহার করছেন। পরে তিনি বুঝতে পারেন, হোয়াটসঅ্যাপে প্রশ্ন বাইরে পাঠিয়ে টোকাটুকি চালিয়ে যাচ্ছেন ওই ছাত্র। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর খাতা কেড়ে নেওয়া হয়। শেক্সপিয়র সরণি থানায় অভিযোগ জানান অধ্যক্ষা। পুলিশ গিয়ে অভিযুক্ত পরীক্ষার্থীকে গ্রেফতার করে। তারা জানায়, ধৃত ছাত্রের নাম রিমন হাসান। তাঁর বাড়ি মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলায়।