দিনযাপন: শিশু কোলে ভিক্ষা চাইছেন এক মহিলা। পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে। ছবি: সুমন বল্লভ
ছেলে না মেয়ে? বয়সই বা কত? দৈনিক মজুরি নির্ধারণে এই উত্তরগুলোই জরুরি। কলকাতা তো বটেই, রাজ্যে সব থেকে বেশি চাহিদা ২-৩ বছর বয়সি শিশুদের। সারা দিনের জন্য কোনও শিশুকে ভিক্ষার কাজে পাঠালে প্রেরক ৫০০-৬০০ টাকা পাবেন। তিনি ওই শিশুর অভিভাবক হোন বা না হোন। আর ঘণ্টা পিছু দর ৫০ টাকা। এর পরেই চাহিদার তালিকায় অসুস্থ বা অঙ্গহানির শিকার বয়স্কেরা। দৈনিক ২০০-৩০০ টাকায় তাঁদের সঙ্গে কথা পাকা হয়। তবে পার্ক স্ট্রিট বা ধর্মতলার মতো জায়গায় ভিক্ষা করলে সেই টাকা আরও বেশি মেলে। চাহিদার নিরিখে সব শেষে থাকেন কিশোর-কিশোরী এবং মহিলারা।
এই হিসেবেই শহর জুড়ে ভিক্ষার ব্যবসা রমরমিয়ে চলছে বলে অভিযোগ। ব্যবসা যারা চালান তাঁরাই ঠিক করেন, কোন কিশোরী কবে কোন শিশুকে কোলে নিয়ে বেরোবে। কয়েক মাস আগে কালীঘাট থানা এলাকার একটি পকসো (দ্য প্রোটেকশন অব চিল্ড্রেন ফ্রম সেক্সুয়াল অফেন্সেস, ২০১২) মামলার তদন্তে এই ব্যবসার চেহারাটাই আরও এক বার সামনে এসেছে। ওই মামলায় তিন জনের বিরুদ্ধে দুই নাবালিকাকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। অভিযুক্তদের দু’জনই নাবালক। তদন্তে জানা যায়, দুই নাবালিকা কালীঘাট মন্দির চত্বরেই ভিক্ষা করে। তাদের এক জনের মা পরিচারিকা। প্রতিদিন তিনি মেয়েকে মন্দির চত্বরে এক ‘মাসি’র কাছে রেখে যান। কথা ছিল, মেয়ে ভিক্ষা করে যা-ই আনুক, তাঁকে প্রতিদিন ১৫০ টাকা করে দেওয়া হবে। সেই মতো কখনও ওই নাবালিকা একা, কখনও ‘মাসির’ ঠিক করা শিশু কোলে নিয়েই ভিক্ষায় বেরোয়।
কোলে কে?
কেউ প্রশ্ন করলেই তাকে শেখানো ছিল মন কেমন করা উত্তর, ‘‘মা অসুস্থ। পাঁচ বোন। ও সবার ছোট। খাব কী?’’ অনেকেই বলছেন, এ তো ব্যবসা! পথেঘাটে অহরহ বাচ্চা কোলে ভিক্ষা করা এমন মেয়েদের দেখা যায়। বাচ্চারা নড়ে না, কাঁদে না। শুধুই ঘুমিয়ে থাকে। কী করে?
কয়েক বছর আগে উত্তর শহরতলির এক স্টেশনে মহিলা ভিখারিকে এ প্রশ্নই করেছিলেন এক শিক্ষিকা। প্রতিদিনই তিনি দেখতেন, মহিলার কোলে একটি শিশু নির্জীব হয়ে শুয়ে। শিক্ষিকা জানতে চান, বাচ্চাটা সব সময়ে ঘুমোয় কেন? প্রথমে অসুস্থতার কাহিনি ফাঁদলেও শিক্ষিকা চেপে ধরায় ওই মহিলা পালাতে চেষ্টা করে। শিক্ষিকা বিষয়টি নিয়ে থানা-পুলিশ করায় জানা যায়, ওই বাচ্চাটি মহিলার নয়। তাকে ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে প্রতিদিন ভিক্ষায় বেরোত মহিলা।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সূত্রের খবর, প্রতিদিন এ দেশে প্রায় ৪০ হাজার শিশু অপহৃত হয়। যার মধ্যে ১০ হাজার শিশু নিখোঁজই থেকে যায়। আরও আশঙ্কার, সারা দেশে প্রায় তিন লক্ষ শিশু প্রতিদিন হয় নেশার কবলে পড়ে, নয়তো মারধরের শিকার হয়ে ভিক্ষা-ব্যবসায় ব্যবহৃত হয়। উদ্বেগ বাড়িয়ে সামাজিক ন্যায় এবং ক্ষমতায়ন মন্ত্রকের সর্বশেষ রিপোর্ট আবার জানিয়েছে, দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিখারি পশ্চিমবঙ্গেই। রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশে ২০১৮-২০১৯ সালে ভিখারির সংখ্যা ছিল ৪ লক্ষ ১৩ হাজার ৬৭০ জন। যার মধ্যে ২ লক্ষ ২১ হাজার ৬৭৩ জন পুরুষ ও ১ লক্ষ ৯১ হাজার ৯৯৭ জন মহিলা। শুধু পশ্চিমবঙ্গেই ভিখারি ৮১ হাজার ২২৪ জন। এর পরেই রয়েছে উত্তরপ্রদেশ (৬৫ হাজার ৮৩৫ জন) এবং অন্ধ্রপ্রদেশ (৩০ হাজার ২১৮ জন)।
রাজ্যের নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজা জানান, শিশুদের দিয়ে ভিক্ষা করানো একেবারেই আইনসিদ্ধ নয়। ২২টি রাজ্যের মতো পশ্চিমবঙ্গেও ভিক্ষা-ব্যবসা রোধে আইন রয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘কোনও শিশু এই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে প্রমাণ পেলে তার পরিবারকে খুঁজে বার করে কারণ জানতে চাওয়া হয়। প্রয়োজনে তাদের সরকারি হোমে রাখা হয়। পরিবারের কাউকে না পাওয়া গেলে আমরাই তাদের দায়িত্ব নিই। বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও এ ব্যাপারে কাজ করে। প্রাপ্তবয়স্কদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেও তাঁদের হোমে রাখি।’’
সরকারি রিপোর্টে ভিক্ষা-ব্যবসার এই চিত্র সত্ত্বেও অভিযোগ ওঠার অপেক্ষা করা হবে কেন? মন্ত্রী বলেন, ‘‘আমরা তো আছিই, পুলিশেরও সহায়তা লাগে।’’ এ প্রসঙ্গে লালবাজারের তরফে কোনও মন্তব্য করতে চাওয়া হয়নি। যুগ্ম কমিশনার পদমর্যাদার এক পুলিশ কর্তা বলেছেন, ‘‘যে কোনও দফতরকেই সব রকম সাহায্য করা হয়। এ ক্ষেত্রেও অন্যথার প্রশ্ন উঠছে না।’’