বাঁকুড়ার সার্কিট হাউস থেকে রবীন্দ্রভবনের পথে। ছবি: অভিজিৎ সিংহ
চিকিৎসা-তরজা
বাঁকুড়া ২ ব্লকের চতুর্ডিহি গ্রামে বিভীষণ হাঁসদার বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজন করে গিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তার পরে বাঁকুড়ায় এসে, মঙ্গলবার বাঁকুড়ার রবীন্দ্রভবনের প্রশাসনিক বৈঠক থেকে তা নিয়ে কটাক্ষ করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
অমিত শাহ ফিরে যাওয়ার পরে ওই পরিবারটির সঙ্গে দেখা করেন বাঁকুড়া শহরের জুনবেদিয়ার জেলা পরিষদের সদস্যা সোনাই মুখোপাধ্যায়। তার পরে শুরু হয় বিতর্ক। বিষয়টি যে তাঁরা ভাল ভাবে নেননি, সে কথা জানিয়েছিলেন জেলা তৃণমূল নেতৃত্ব। এ দিন বৈঠকে সোনাইদেবী তাঁর ওই বাড়িতে যাওয়ার প্রসঙ্গটি তোলেন। বলেন, ‘‘আমি পরিবারটিকে পরিবারকে সাধ্যমতো সাহায্য করেছি। কিছু মন্তব্য চিরকুটে লিখে রেখেছি। আপনাকে দিতে চাই।’’ মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘ওরা বাচ্চাটার চিকিৎসার জন্য বলেছিল তো? সেটা ডিএম লোক পাঠিয়ে কথা বলে নিয়েছে। রাজ্য সরকার দায়িত্ব ইতিমধ্যেই নিয়ে নিয়েছে। ওরা তো রাজনীতি করতে এসেছিলেন। পাঁচতারা হোটেলের খাবার নিয়ে এসে ওখানে কিছুক্ষণের জন্য ভাড়া নিয়ে এসে খেয়ে পালিয়েছেন। কিন্তু মেয়েটার চিকিৎসা করেনি।’’ বাঁকুড়ার জেলাশাসক এস অরুণপ্রসাদ মুখ্যমন্ত্রীকে জানান, ওই শিশুটিকে ডাক্তার দেখে এসেছেন। আশাকর্মী রোজ যাচ্ছেন। মেয়েটির ওষুধের ব্যবস্থাও নিয়মিত করা হচ্ছে।
সোনাইদেবী মুখ্যমন্ত্রীকে জানান, তিনি ঠিক কাজ করেছেন কি না তা নিয়ে দ্বিধায় রয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘তুমি গিয়েছিলে বলে অনেক ধন্যবাদ।’’ তাঁর চিরকুটটি সফরসঙ্গী সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেওয়ার নির্দেশ দেন। এই বিষয়ে বাঁকুড়ার বিজেপি সাংসদ সুভাষ সরকার বলেন, ‘‘আমরা মেয়েটির চিকিৎসা করাচ্ছি। ওই পরিবারটি এত দিন অভাবের সঙ্গে লড়াই করছিল। রাজ্য সরকারের নজরে এল না কেন? তা হলে মানুষের দুঃখ ঘোচাতে তো বার বার অমিতজিতে নিয়ে আসতে হবে।’’ আর বিভীষণ হাঁসদা বলেন, ‘‘স্থানীয় স্বাস্থ্য দফতর ও বিজেপি নেতৃত্ব— দু’তরফেই সাহায্য পাচ্ছি।’’
সমাধানের আশ্বাস
রবিবারর দুপুরে হেলিপ্যাডে নামার পরেই মুখ্যমন্ত্রীর নাম ধরে ডাকাডাকি করছিলেন কয়েক জন বধূ। দেখতে পেয়ে লোক পাঠিয়ে মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের থেকে লিখে আনা দাবিপত্র নেন। মুকুটমণিপুর সংলগ্ন গোড়াবাড়িতে কংসাবতী সেচ কলোনির পরিত্যক্ত আবাসনে থাকা ওই সমস্ত মানুষজনের অসুবিধা দূর করতে মঙ্গলবার বাঁকুড়ার প্রশাসনিক বৈঠক থেকে নির্দেশও দিলেন তিনি। এ দিন কংসাবতী সেচ ক্যানালগুলি সংস্কারের ফলে দূরের এলাকায় জল পৌঁছনোর কথা বলছিলেন সেচ দফতরের সচিব নবীন প্রকাশ। তখনই ওই আবাসনে সমস্যার কথা জানিয়ে প্রকল্পের টাকা থেকে বিষয়টি দেখে নিতে তাঁকে নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রীর সফরসঙ্গী আইনজীবী-সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, সেখানে ৭৬টি পরিবার সমস্যার মধ্যে রয়েছে। এই খবরে খুশি কলোনির বধূ মধুমিতা সরকার, কবিতা দত্ত, নন্দিনী সাহু, ময়না বাউড়ি। তাঁরা জানান, সেচ দফতরে চাকরির সূত্রে এসে থেকে গিয়েছে কিছু পরিবার। আবাসনের বাকি অধিকাংশ বাসিন্দাই উদ্বাস্তু। কেউ তিন দশক, কেউ আরও বেশি সময় পরিবার নিয়ে আছেন। সবাই দিনমজুর। মাথার উপরে ছাউনি ফেটে গিয়েছে। পানীয় জল, বিদ্যুৎ নেই। তাঁরা বলেন, ‘‘জমি কিনে বাড়ি বানানোর ক্ষমতা নেই। এখন দিদি আমাদের স্থায়ী বাড়ি দিলে খুব উপকৃত হব।’’
নিয়ম মেনে নৌকা
মুকুটমণিপুর জলাধারে হুড়োহুড়ি করে নৌকায় পর্যটক তোলা নিয়ে বাঁকুড়ার জেলাশাসককে নির্দেশ দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। মঙ্গলবার বাঁকুড়ার প্রশাসনিক বৈঠকে বিষয়টি তোলেন মুখ্যমন্ত্রীর সফরসঙ্গী শ্রীরামপুরের সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘আমি নিজেও কালকে শুনছি মাইকে। বলছে, ‘এই মশাই আপানাকে যেতে বারণ করছি, আপনি যাচ্ছেন কেন?’ এটা নিয়ে বোধ হয় প্রতিযোগিতা চলে। এই করে যদি কারও মৃত্যু হয়ে যায়, সেটা তো আমার কৃতিত্ব নয়।’’ মুকুটমণিপুর নৌকাবিহার সমবায় সমিতির সম্পাদক তারাপদ সিং সর্দার বলেন, ‘‘অনেক সময় পর্যটকদের মাইকে ডাকা হয়। বলা হয়, কোথায় কোথায় ঘুরতে হয়। আর কিছু বলা হয় না।’’ তাঁর দাবি, প্রত্যেক পর্যটককে লাইফ জ্যাকেট পরিয়ে নৌকায় তোলা হয়। এক এক করে নৌকা ছাড়া হয়। তিনি বলেন, ‘‘কোথাও কোনও ত্রুটি থাকলে আমরা সংশোধন করার চেষ্টা করব।’’ মুকুটমণিপুর উন্নয়ন পর্ষদের ভাইস চেয়ারপার্সন তথা রানিবাঁধের তৃণমূল বিধায়ক জ্যোৎস্না মান্ডি বলেন, ‘‘পর্যটকদের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে যাতে নিয়ম মেনে নৌকা চালানো হয়, সেটা গুরুত্ব সহকারে দেখা হবে।’’ অন্য বারের মতো মুকুটমণিপুরে ঘুরতে না বেরলেও মুখ্যমন্ত্রীর কানে যে বিষয়টি পৌঁছে গিয়েছে, তাতে অবাক স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অনেকে।
মাছ চাষ নিয়ে
জলাধারে মাছ চাষের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন করলেন মুকুটমণিপুর উন্নয়ন পর্ষদের ভাইস চেয়ারপার্সন তথা রানিবাঁধের তৃণমূল বিধায়ক জ্যোৎস্না মান্ডি। মঙ্গলবার বাঁকুড়ার রবীন্দ্রভবনে প্রশাসনিক বৈঠকে তিনি বলেন, ‘‘মুকুটমণিপুর জলাধারকে কেন্দ্র করে ১৯৮৮ সালে একটি মাছ চাষের প্রকল্প ছিল। সেটি আবার চালু হলে লকডাউনে কাজ হারিয়ে ফেরা অনেক পরিযায়ী শ্রমিক উপকৃত হবেন।’’ প্রস্তাবটির প্রশংসা করেন মুখ্যমন্ত্রী। সংশ্লিষ্ট সচিবকে বিষয়টি দেখতে বলেন। জ্যোৎস্নাদেবী জানান, তিনি বিস্তারিত প্রকল্প রিপোর্ট তৈরি করে সঙ্গে এনেছেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘হাতে করে নিয়ে এসো। পুলিশকে দাও। স্যানিটাইজ় করে দিয়ে দেবে।’’
মনসার থান
মনসার থানগুলি বাঁধিয়ে দেওয়ার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আর্জি জানালেন রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী তথা কোতুলপুরের তৃণমূল বিধায়ক শ্যামল সাঁতরা। বাগদি এবং বাউড়ি কালচারাল বোর্ড গঠনের প্রসঙ্গ তুলে বৈঠকে তিনি বলেন, ‘‘বাগদি এবং বাউড়িদের বড় দেবী মনসা। এখানে আমাদের গাছের তলায় মনসা বেদি আছে। সেখানে ঠাকুর থাকে। এই বেদিগুলোকে যদি বাঁধিয়ে দেওয়া যায়। পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকা লাগবে।’’ মুখ্যমন্ত্রী আশ্বাস দেন। মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলেন, ‘‘আমরা তো জহর থান করছি। মনসাদেবীর থানটাও বাঁধিয়ে দিন না। অল্প অল্প করে করে দিন।’’
জাইকাকে দায়ী
পুরুলিয়ায় জল প্রকল্প চালুতে দেরির জন্য জাপানের সংস্থা জাইকাকে দায়ী করলেন মুখ্যমন্ত্রী। এ দিনের বৈঠকে তিনি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ায় জল সরবরাহ প্রকল্পের পাইপ দ্রুত পাতার নির্দেশ দেন। মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ করেন, ‘‘পুরুলিয়াকে ঝুলিয়েছে জাইকা। সাত বছর ধরে প্রকল্পটা করবে করবে করে দেরি করছে। এত ওদের খুঁটিনাটি আর এত সময় নষ্ট করেছে।’’ পুরুলিয়ার যে সমস্ত খরাপ্রবণ এলাকায় এখনও জল যায়নি, সেখানে যাতে মার্চের পরে অসুবিধা না হয়, সে জন্য আগে থেকে পরিকল্পনা করে রাখার নির্দেশ দেন। সংশ্লিষ্ট সচিব জানান, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ার ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। বেশ কিছু প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। প্রায় চারশো নলকূপ খোঁড়া হবে। তিনি বলেন, ‘‘জাইকার প্রকল্পের টেন্ডারগুলি হয়ে গিয়েছে। আগামী মাসের মধ্যে ওয়ার্ক অর্ডার হয়ে যাবে।’’
নতুন শিল্প তালুক
গঙ্গাজলঘাটিতে তেত্রিশ একর জমিতে নতুন শিল্প তালুক তৈরি করতে চলেছে রাজ্য সরকার। মঙ্গলবার রাজ্যে মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক বৈঠকে দাবি করেন, ‘‘গঙ্গাজলঘাটিতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেটের শিলান্যাস সোমবার মুখ্যমন্ত্রী করেছেন। ওটা হলে সেখানে অনেকগুলো ক্ষুদ্র শিল্প তৈরি হবে।’’
মুখ্যমন্ত্রী সেই প্রসঙ্গ টেনে জানান, ডানকুনি থেকে বর্ধমান, দুর্গাপুর, বড়জোড়া, রঘুনাথপুর হয়ে একটা বড় ডেডিকেটেড ফেট করিডোর তৈরি করা হবে। কাজকর্ম চলছে আস্তে আস্তে। সেই ইন্ডাস্ট্রি সেটআপ হলে লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ের কাজ হবে। বর্ধমান জেলা, বাঁকুড়া জেলা, হুগলি জেলা, পুরুলিয়া, বীরভূমের সুবিধা হবে।
আবর্জনা, নালিশ
কোভিড পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখেছেন ছাতনা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের মূল গেটের বাইরে সাফাই না হওয়া আবর্জনার ভ্যাট। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তা নিয়ে অভিযোগ জানালেন ছাতনার বিধায়ক ধীরেন্দ্রনাথ লায়েক। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘সামনে থাকলে ভ্যাট খাকলে এমনিতেই তো রোগ ছড়াবে।’’ এই নিয়ে পদক্ষেপ করার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।