রাজ্যের সদ্য প্রাক্তন মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে শো-কজ করল কেন্দ্রীয় সরকার। ২০০৫ সালের বিপর্যয় মোকাবিলা আইনের আওতায় তাঁকে শো কজ করা হয়েছে। সোমবার তাঁর কাছে ওই চিঠি পৌঁছেছে। তিন দিনের মধ্যে, অর্থাৎ বৃহস্পতিবারের মধ্যে আলাপনকে জবাব দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আনন্দবাজার ডিজিটালের হেফাজতে ওই চিঠিটি এসেছে। তার ভাষা যথেষ্ট কঠোর। নবান্ন সূত্রের খবর, আলাপন যথাবিহিত চিঠির জবাব দেবেন। তার আগে মঙ্গলবার বিকেলে তিনি নবান্নে গিয়ে তাঁর নতুন দায়িত্ব ভার গ্রহণ করবেন। প্রসঙ্গত, মুখ্যমন্ত্রী মুখ্য উপদেষ্টা ছাড়াও আলাপনকে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (এটিআই)-এর ডিরেক্টর পদে নিয়োগ করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের আন্ডার সেক্রেটারি আশিস কুমার সিংহের পাঠানো ওই চিঠিতে আলাপনকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিব বলেই বর্ণনা করা হয়েছে। চিঠিতে লেখা হয়েছে, ‘বিপর্যয় মোকাবিলা আইনের (২০০৫) ৫১ ধারা অনুযায়ী ওই আইন উল্লঙ্ঘন করার জন্য কেন তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা তিন দিনের মধ্যে লিখিত ভাবে জানানো হোক’। আলাপন ওই শো কজ নিয়ে কোনও মন্তব্য করেননি। তবে নবান্ন সূত্রের খবর, তিনি যথাবিহিত ওই চিঠির জবাব দেবেন। নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যেই দেবেন। আলাপনের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তার সারবত্তা হল— গত শুক্রবার কলাইকুন্ডায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ইয়াস পর্যালোচনা বৈঠকে কেন তিনি উপস্থিত ছিলেন না। চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী হলেন জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা কর্তৃপক্ষের প্রধান। তাঁর বৈঠকে উপস্থিত না থেকে আলাপন যা করেছেন, তা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে বিপর্যয় মোকাবিলা আইনের ৫১(বি) ধারা ভঙ্গের শামিল।
কেন্দ্রীয় সচিবের পাঠানো চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, আকাশপথে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের ক্ষয়ক্ষতি দেখে প্রধানমন্ত্রী কলাইকুন্ডা বিমানঘাঁটিতে পৌঁছন। সেখানেই তাঁর মুখ্যমন্ত্রী এবং মুখ্যসচিবের সঙ্গে পর্যালোচনা বৈঠক করার কথা ছিল। যে ঘরটিতে বৈঠক হওয়ার কথা ছিল, সেখানে পৌঁছনোর পর প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর সফরসঙ্গীরা রাজ্য সরকারের আধিকারিকদের পৌঁছনোর জন্য অন্তত ১৫ মিনিট অপেক্ষা করেন। তাঁদের সেখানে না দেখে একজন আধিকারিক মুখ্যসচিবের কাছে জানতে চান, তাঁরা কি আদৌ ওই বৈঠকে অংশ নেবেন নাকি নেবেন না? তার পরে মুখ্যসচিব মুখ্যমন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বৈঠককক্ষে পৌঁছন এবং সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে যান। ওই পুরো ঘটনাপ্রবাহে একজন সরকারি আধিকারিক হিসেবে মুখ্যসচিব আলাপন আইন ভঙ্গ করেছেন বলে চিঠিতে স্পষ্টই বলা হয়েছে। তারই পাশাপাশি ওই কাজের ব্যাখ্যাও চাওয়া হয়েছে।
শুক্রবার দুপুরে ওই ঘটনার পর ওইদিন রাতেই আলাপনকে দিল্লিতে বদলির নির্দেশ পাঠায় কেন্দ্র। সোমবার সকাল ১০টায় তাঁকে নয়াদিল্লিতে নর্থ ব্লকে কর্মিবর্গ মন্ত্রকে পৌঁছনোর নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু আলাপন তা যাননি। তার আগে শনিবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাংবাদিক বৈঠক করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ওই নির্দেশ ফিরিয়ে নেওয়ার আবেদন জানান। কিন্তু নির্দেশ প্রত্যাহার করা হয়নি। রাজ্য সরকারেও আলাপনকে ছাড়েনি। ফলে সোমবার দিল্লি যাননি আলাপন। বদলে ওই দিনই তিনি সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে নেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী নিজের মুখ্য উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োগের কথা ঘোষণা করেন। আগামী তিন বছরের জন্য আলাপন ওই পদে থাকবেন। নবান্নেই হবে তাঁর দফতর।
নবান্ন সূত্রে মঙ্গলবার জানা গিয়েছে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই কেন্দ্রের পাঠানো ওই শো কজের উত্তর দেবেন আলাপন। প্রধানমন্ত্রীর পর্যালোচনা বৈঠকে আলাপন এবং মুখ্যমন্ত্রীর অনুপস্থিতি ঘিরে কেন্দ্র-রাজ্য সঙ্ঘাতের আবহ তৈরি হয়েছিল। সোমবার আলাপনের রাজ্যের মুখ্যসচিব পদ থেকে ইস্তফার পর সেই সঙ্ঘাতে ইতি পড়েছিল বলেই মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু ঘটনাচক্রে, একই দিনে কেন্দ্রের আলাপনকে শো কজ বুঝিয়ে দিল, কেন্দ্রীয় সরকারস অত সহজে বিষয়টি ছেড়ে দেবে না। প্রথম রাউন্ডে মমতা এগিয়ে থাকলেও পরবর্তী পর্যায়ে কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন ভাবে তাদের উষ্মা এবং অসন্তুষ্টির কথা জানিয়ে দেবে। এখন দেখার, আলাপন ওই শো কজের কী জবাব দেন। মুখ্যমন্ত্রী নিজে ওই শো কজ নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া জানান কি না। আলাপন-অধ্যায়ে রাজ্যের প্রাক্তন শীর্ষ আমলারা সকলেই আলাপনের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁরা এখনও প্রাক্তন মুখ্যসচিবের পাশেই আছেন। সামগ্রিক ভাবে রাজ্যের বড় অংশের জনতাও কেন্দ্রের সঙ্গে এই সঙ্ঘাতে রাজ্যের পাশেই দাঁড়িয়েছে। এখন দেখার, কেন্দ্রের এই শো কজ নোটিসের পর কোথাকার জল কোথায় গড়ায়।