প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: পিটিআই।
কলাইকুন্ডার বৈঠক থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কোনও অনুমতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেননি বলে কেন্দ্রীয় সরকার দাবি করল।
আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন তুলে সোমবার সকালে মুখ্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। সেই চিঠিতেই মমতা প্রধানমন্ত্রীকে ‘স্মরণ করিয়ে দিয়ে’ জানিয়েছিলেন, তিনি কলাইকুন্ডার বৈঠক থেকে মুখ্যসচিবকে নিয়ে দিঘায় বিপর্যয় খতিয়ে দেখতে রওনা হওয়ার আগে ‘নির্দিষ্ট ও স্পষ্ট ভাবে’ প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি চেয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী ‘স্পষ্ট ভাবে’ এই অনুমতি দিয়েছিলেন। মমতার যুক্তি ছিল, গোটা বিতর্কের সেখানেই ইতি টানা উচিত ছিল। কিন্তু মঙ্গলবার সকালে মোদী সরকারের শীর্ষ সূত্রের দাবি, প্রধানমন্ত্রী এমন কোনও অনুমতি দেননি। কেন্দ্রীয় সরকারের সূত্রে আজ মুখ্যমন্ত্রীর পাঁচ পৃষ্ঠার চিঠিতে বিভিন্ন বক্তব্যের ন’দফা জবাব দেওয়া হয়েছে। সূত্রের দাবি, একই জবাব রাজ্যকেও পাঠানো হবে। তবে পর্যবেক্ষকদের একাংশ বলছেন, মমতা যেখানে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন, সেখানে তাঁকে সরকারি ভাবে জবাব দেওয়ার আগে ‘সূত্র’ মারফত কিছু বক্তব্য জানানোর অর্থটা কী আর তা কতটা শোভন?
গত শুক্রবার ইয়াসের ক্ষয়ক্ষতির পর্যালোচনায় প্রধানমন্ত্রীর ডাকা বৈঠক ঘিরে কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত তৈরি হয়। এর পরেই আলাপনকে দিল্লিতে রিপোর্ট করতে বলা হয়। মুখ্যমন্ত্রী তাঁর সোমবারের চিঠিতে জানিয়েছিলেন, তাঁর আগেভাগেই ইয়াসের ক্ষয়ক্ষতি খতিয়ে দেখার কর্মসূচি ছিল। প্রধানমন্ত্রীর সফরের জন্য তিনি সে সবে রদবদল করেন। কেন্দ্রীয় সরকারি সূত্রের দাবি, প্রধানমন্ত্রীও ইয়াসের ক্ষয়ক্ষতি দেখতেই গিয়েছিলেন। তাঁর কর্মসূচি ঝড় আসার আগেই চূড়ান্ত করে ফেলা সম্ভব ছিল না। আমপান পরবর্তী সফরের মতোই এ বার প্রধানমন্ত্রীর সফরসূচি একইসঙ্গে ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে জানানো হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের আগেই প্রধানমন্ত্রী ওড়িশা গিয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও ওড়িশায় মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক পরিকল্পনা মাফিকই হয়েছিল।
মুখ্যমন্ত্রী তাঁর চিঠিতে জানিয়েছিলেন, তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবেন বলেই কলাইকুন্ডা যাওয়ার আগে হিঙ্গলগঞ্জ ও সাগরে যান। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর চপারের জন্যই সাগরে তাঁর চপার আটকে দেওয়া হয়। তিনি ২০ মিনিট সেখানে অপেক্ষা করেন। তা সত্ত্বেও তিনি বেলা আড়াইটের আগে কলাইকুন্ডা পৌঁছে গিয়েছিলেন।
কেন্দ্রের সূত্রের পাল্টা দাবি, প্রধানমন্ত্রী কলাইকুন্ডা পৌঁছন বেলা ১টা ৫৯ মিনিটে। মমতা তারপরে বেলা ২টো ১০ মিনিটে সেখানে পৌঁছেছিলেন। প্রত্যাশিত ছিল, তিনি প্রধানমন্ত্রীর আগে পৌঁছবেন। উল্টে প্রধানমন্ত্রীই তাঁর জন্য অপেক্ষা করেছিলেন। জনৈক তৃণমূল সাংসদও টুইট করে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর অপেক্ষা করাটা বড় ব্যাপার নয়। রাজ্যের অবশ্য পাল্টা যুক্তি, মুখ্যমন্ত্রী না থাকলেও রাজ্যের মন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্র, জেলাশাসক ও জেলার পুলিস সুপার প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে সেখানে ছিলেন।
কেন্দ্রের যুক্তি, মুখ্যমন্ত্রী চপার থেকে নেমে ৫০০ মিটার দূরে বৈঠকের জন্য নির্দিষ্ট ভবনে পৌঁছন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে তিনি বেলা ২টা ৩৫ মিনিটে রওনা হয়ে যান। অর্থাৎ কলাইকুন্ডায় তিনি মাত্র ২৫ মিনিট ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর আগেই তিনি বেরিয়ে যান। যা ‘প্রোটোকল ও সর্বজনগ্রাহ্য নিয়মের’ বিরুদ্ধে। প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক শেষ হওয়া পর্যন্ত তাঁকে অপেক্ষা করতে হবে বুঝেই মুখ্যমন্ত্রী বেরিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি অফিসারদেরও বৈঠকে যোগ দিতে দেননি বলে ওই সূত্রের অভিযোগ।
মমতা জানিয়েছিলেন, তাঁর দিঘা যাওয়ার সফরসূচি আগে থেকেই ঠিক ছিল। কেন্দ্রের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রী প্রথমে বৈঠকে যোগ দিতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বৈঠকে থাকবেন জেনে পরে মত বদলান। তাঁর চিঠিতেও সেই ইঙ্গিত রয়েছে। ফলে পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি কোনও সমস্যা নয়। রাজ্যপালও জানিয়েছেন, মমতা তাঁকে বলেছিলেন যে শুভেন্দু থাকলে তিনি বৈঠক বয়কট করবেন। মমতার অভিযোগ ছিল, তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করতে চেয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর দফতরে তিনি বার্তাও পাঠান। ইতিবাচক বার্তাও মিলেছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী পরে বৈঠকের কাঠামো বদলে সেখানে বিজেপির স্থানীয় বিধায়ককে ডেকে পাঠান। প্রধানমন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রী বৈঠকে তাঁর থাকার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, তিনি রাজ্যপাল বা কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের বৈঠকে হাজিরা নিয়ে আপত্তি জানাননি।
কেন্দ্রীয় সূত্রের পাল্টা জবাব, উক্ত স্থানীয় বিধায়ক বিধানসভার বিরোধী দলনেতা। অ-বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে একাধিক বৈঠকে এর আগে অন্য দলের প্রতিনিধিদের ডাকা হয়েছে। তৃণমূল শিবির অবশ্য মনে করিয়ে দিচ্ছে, গুজরাতে প্রধানমন্ত্রী যখন ঘূর্ণিঝড়ের পর্যালোচনা করতে গিয়েছিলেন, তখন সেখানে কংগ্রেসের বিরোধী দলনেতাকে ডাকা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী দিল্লিতেও কোভিড নিয়ে বিরোধী শিবিরের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেননি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এসে তিনি শুভেন্দুকে বৈঠকে রাখতে অনড় মনোভাব দেখালেন।
মুখ্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে অভিযোগ তুলেছিলেন, মুখ্যসচিব হিসেবে আলাপনের মেয়াদ বৃদ্ধির পরেও তাঁকে দিল্লিতে ডেকে পাঠানোটা রাজ্যের মানুষের স্বার্থের বিরোধী। কেন্দ্রের যুক্তি, প্রধানমন্ত্রীর দফতরের অধীন কর্মিবর্গ মন্ত্রক বরং আলাপনের মেয়াদ বাড়াতে রাজি হয়ে বার্তা দিয়েছিল, কেন্দ্র রাজ্যের সঙ্গে সহযোগিতাই করতে চায়। কিন্তু মুখ্যসচিব হিসেবে আলাপন নিজের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করেননি বলেই তাঁর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা হয়েছে।