যে প্রভাব খাটিয়ে তিনি দীর্ঘদিন হাসপাতালে থেকে গিয়েছিলেন, যে প্রভাবের জন্য হাসপাতালে তাঁকে ঘিরে থেকেছেন তাঁর অনুচরেরা, জেলে থাকাকালীনও যে প্রভাব তাঁকে ভিআইপি-র মর্যাদা দিয়েছে, মদন মিত্রের সেই প্রভাব কমাতেই তাঁকে ওড়িশায় নিয়ে যেতে চায় সিবিআই।
সূত্রের খবর, ১ ডিসেম্বর ওড়িশা হাইকোর্টে রোজ ভ্যালি নিয়ে শুনানির সময়ে প্রথমে সেই সংস্থার কর্ণধার গৌতম কুণ্ডুর বডি ওয়ারেন্টের জন্য আবেদন জানানো হবে। প্রথমে গৌতমকে নিয়ে যাওয়া হবে ওড়িশায়। তার কয়েক দিনের মধ্যেই মদন মিত্র।
৩১ অক্টোবর নিম্ন আদালত থেকে জামিন পেয়ে গিয়েছিলেন মদন। তার বিরুদ্ধে আদালতে আবেদন করে সিবিআই। গত ১৯ নভেম্বর সেই জামিনের নির্দেশ হাইকোর্ট খারিজ করে দিয়ে তাঁকে আবার জেলে পাঠিয়ে দেয়। সেই নির্দেশেই কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি নীশিথা মাত্রে ও বিচারপতি তাপস মুখোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চ মন্তব্য করেন, শুধু তদন্ত বা সাক্ষী নয়, বিচার ব্যবস্থার উপরেও মদন মিত্রের প্রভাব থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। হাইকোর্টের এই পর্যবেক্ষণকেই পাখির চোখ করে এগোতে চাইছে সিবিআই।
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সারদা মামলায় যোগ থাকার সন্দেহে মদন মিত্রকে গ্রেফতার করা হয়। প্রথম দিকে যে কয়েকবার তাঁকে আদালতে পেশ করা হয়েছিল, তখনই গণ্ডগোল হয়েছিল। সেই সময়ে সিবিআই কৌঁসুলিকে কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। সেই সময়েই সিবিআইয়ের তরফে বলা হয়েছিল, এ রাজ্যের আদালতে সুষ্ঠু ভাবে সওয়াল করতে না পারলে এই মামলা অন্য রাজ্যে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার আর্জি জাননো হবে।
তারপর অনেকটা সংযত হয়ে যান মদন-ঘনিষ্ঠরা। মদন মিত্র চলে যান হাসপাতালে। আর তবে থেকে বিভিন্ন সময়ে তাঁর অসুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করে সিবিআই। এমনকী আদালতের মাধ্যমে হাসপাতালের কাছ থেকে রিপোর্টও চেয়ে পাঠানো হয়।
শেষ যে দিন কলকাতা হাইকোর্টে বিচারপতি নীশিথা মাত্রে ও বিচারপতি তাপস মুখোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চে মদন মিত্রের জামিন বাতিল হয়ে যায় সে দিনও শুনানির সময়ে সিবিআইয়ের পক্ষ থেকে মদনের হাসপাতালে ভর্তি নিয়ে কড়া প্রতিক্রিয়া জানায় সিবিআই।
সিবিআই আইনজীবী কে রাঘবচারিলু সে দিন আদালতে জানিয়েছিলেন, প্রভাব খাটিয়ে মদন মিত্র জেলে না থেকে হাসপাতালের ‘প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুট’-এ থাকছেন। সেখানে তিনি যাবতীয় সুবিধা পাচ্ছেন। অভিযোগ ওঠে, এত দিন এত কঠিন অসুখ বলে তিনি হাসপাতালে ভর্তি থাকলেন আর ৩১ অক্টোবর যেই জামিন পেয়ে গেলেন অমনি তিনি সুস্থ হয়ে পরের দিন বাড়ি ফিরে গেলেন। আইনজীবীর বক্তব্য ছিল, ‘‘বুঝেই দেখুন কতটা অসুস্থ ছিলেন তিনি।’’
হাসপাতাল থেকে ছাড়ার সময়ে যে ‘ডিসচার্জ সার্টিফিকেট’ দেওয়া হয়েছিল তারও উল্লেখ করে সে দিন আদালতকে বলা হয়, ছেড়ে দেওয়ার সময়ে ওষুধের তালিকায় তিনটি ভিন্ন সংস্থার তৈরি একই নাকের ড্রপ তিন বার লেখা হয়েছে।
এর আগে বিভিন্ন সময়ে আদালতে সওয়ালের সময়ে বার বার বলা হয়েছে তাঁর প্রভাব খাটানোর কথা। এর মাঝেই তাঁর মন্ত্রীত্ব চলে যায়। সিবিআইয়ের মতে, এই সময়ে কলকাতা থেকে তাঁকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে গিয়ে জেরা করলে আরও অনেক তথ্য জানা যেতে পারে। কলকাতার জেলে বা হাসপাতালে যেখানেই তিনি থাকুন না কেন, জানেন তাঁর চারপাশে তাঁকে ঘিরে রেখেছেন তাঁরই অনুগতরা। হাসপাতালে চিকিৎসক ও চিকিৎসা-কর্মীরা। জেলে অন্য বন্দি বা ওয়ার্ডেনরা।
ওড়িশায় নিয়ে গিয়ে সেখানকার জেলে রাখলে তাঁকে আর দশটা সাধারণ বন্দির মতোই দেখা হবে। সেখানে তাঁকে দেখে স্যালুট করার কেউ থাকবে না। মনে করা হচ্ছে, এতে এক দিকে যেমন আরও ভেঙে পড়তে পারেন মদন, তেমনই তিনি নিজে থেকে কিছু বলতে চাইলেও তা সহজে বলতে পারবেন।
কলকাতার একটি পাঁচতারা হোটেলে বেশ কয়েকবার গিয়ে রাতে থাকা, দামী পাণীয় ও খাবার খাওয়া নিয়ে অভিযোগ উঠেছে মদন মিত্রের বিরুদ্ধে। এই বিলাসের বেশিরভাগ টাকাই গৌতম কুন্ডু মিটিয়েছিলেন বলে সিবিআই সূত্রে জানা গিয়েছে। এর বাইরেও রোজ ভ্যালির সঙ্গে তাঁর আর কী কী লেনদেন হয়েছে তাও বিস্তারিত জানতে চায় সিবিআই।
চাইলে তো অসমেও নিয়ে যাওয়া যেত। ওড়িশা কেন?
সিবিআইয়ের মতে, ওড়িশায় রোজ ভ্যালির বিরুদ্ধে মামলা অনেক শক্তপোক্ত। ওই সংস্থার বিরুদ্ধে করা অভিযোগের পরিমান যেমন ওই রাজ্যে বেশি, তেমনই ওই মামলায় সাক্ষীর সংখ্যাও বেশি।