মহুয়া মৈত্রের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন সিবিআই আধিকারিকেরা। — ফাইল চিত্র।
সকাল ৭টা থেকে থেকে রাত ৯টা ৫৮। কলকাতা, কৃষ্ণনগর এবং করিমপুর। বহিষ্কৃত তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্রের চার আস্তানায় সারা দিন ধরে হানা দিল সিবিআই। মহুয়ার বিরুদ্ধে ওঠা টাকার বিনিময়ে প্রশ্নের অভিযোগ নিয়ে গত সোমবার সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয় লোকপাল। বরখাস্ত তৃণমূল সাংসদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগকে ‘গুরুতর’ বলে বর্ণনা করা হয় লোকপালের নির্দেশিকায়। মহুয়ার বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করে তদন্ত শুরু করে সিবিআই। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার সূত্রে জানা যায়, ‘ঘুষ নিয়ে প্রশ্ন’কাণ্ডে লোকপালের নির্দেশে তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা হয়েছে। শনিবার সকালে আলিপুরে ‘রত্নাবলী’ আবাসনে যায় সিবিআইয়ের একটি দল। জানা যায়, সেখানে ন’তলার একটি ফ্ল্যাটে থাকেন মহুয়ার বাবা দীপেন্দ্রলাল মৈত্র এবং মা মঞ্জু মৈত্র। সিবিআই সূত্রে জানা যায়, ঘুষের বিনিময়ে প্রশ্নকাণ্ড সংক্রান্ত মামলার তদন্তেই তাদের অভিযান।
শনিবার দুপুরে নদিয়ার কৃষ্ণনগরে পৌঁছয় সিবিআইয়ের আরও একটি দল। মহুয়ার সাংসদ কার্যালয় এবং তার পিছনের দলীয় দফতরে হানা দেয় তারা। কৃষ্ণনগরের সিদ্ধেশ্বরীতলায় যেখানে মহুয়ার সাংসদ কার্যালয় রয়েছে, সেখানে যায় সিবিআইয়ের পাঁচ সদস্যের একটি দল। বাড়ির বাইরে ছিলেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানেরাও। ওই সময় তল্লাশি শুরু হয়, পিছনের নির্বাচনী দফতরেও। এই দফতর থেকে মহুয়া নির্বাচনী কাজকর্ম পরিচালনা করতেন বলে জানা গিয়েছে। সব শেষে করিমপুরে মহুয়ার ভাড়াবাড়িতে পৌঁছয় সিবিআই। সিবিআইয়ের তল্লাশি অভিযান শেষ হওয়ার পরেই নিজের এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে একটি পোস্ট করে বিজেপিকে আক্রমণ করেন মহুয়া।
‘টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন’কাণ্ডে মহুয়ার বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ তুলেছিলেন বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে। তিনি দাবি করেন, দুবাইয়ের শিল্পপতি দর্শন হীরানন্দানির কাছ থেকে টাকা নিয়ে সংসদে প্রশ্ন করেছেন মহুয়া। পরিকল্পনামাফিক সংসদে ‘নিশানা’ করেন শিল্পপতি গৌতম আদানিকে। অভিযোগ, সবটাই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে অস্বস্তিতে ফেলার জন্য। এই অভিযোগ জানিয়ে লোকসভার স্পিকারকে চিঠি দিয়ে মহুয়াকে সাংসদ পদ থেকে বরখাস্ত করার দাবি তোলেন ওই বিজেপি সাংসদ। তার আগে মহুয়ার প্রাক্তন বান্ধব জয় অনন্ত দেহাদ্রাইয়ের বিভিন্ন অভিযোগে সিবিআই তদন্তের দাবি জানানো হয়েছিল।
অন্য দিকে, মহুয়া প্রথম থেকেই এই অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছেন। যদিও শিল্পপতি হীরানন্দানি নিজে একটি হলফনামা দিয়ে জানান, মহুয়ার লগ ইন আইডি পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে প্রশ্ন টাইপ করতেন তিনি। কিন্তু ঘুষের অভিযোগ মানেননি। নিজের লগ ইন আইডি দেওয়ার কথা স্বীকার করলেও ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উড়িয়ে দেন মহুয়াও। তিনি অভিযোগ করেন, তাঁর বক্তব্য না শুনেই লোকসভার এথিক্স কমিটি তাঁকে একতরফা ভাবে বহিষ্কারের সুপারিশ করেছে।
গত বছরের ৮ ডিসেম্বর সেই সিদ্ধান্ত লোকসভায় পাশ হয়ে যায়। এর পর তাঁর সাংসদ পদ খারিজের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন মহুয়া। সম্প্রতি সেই মামলায় শীর্ষ আদালতের এক্তিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে লোকসভার সচিবালয়। সুপ্রিম কোর্টের নোটিসের উত্তরে গত ১২ মার্চ লোকসভার সচিবালয় জানিয়েছে, সংবিধানের ১২২ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইনসভার অভ্যন্তরীণ কর্মপদ্ধতিতে বিচার বিভাগ হস্তক্ষেপ করতে পারে না।
তল্লাশিতে কী পেল সিবিআই
শনিবার সকালে আলিপুরের ‘রত্নাবলী’ আবাসনে যায় সিবিআইয়ের একটি দল। ওই আবাসনের ন’তলার একটি ফ্ল্যাটে থাকেন মহুয়ার বাবা দীপেন্দ্রলাল এবং মা মঞ্জু। শনিবার সকাল ৭টা নাগাদ ওই আবাসনে পৌঁছন সিবিআইয়ের আধিকারিকেরা। সিবিআই সূত্রে জানা যায়, আবাসনের কেয়ারটেকারকে দিয়ে মহুয়ার মা মঞ্জুকে ফোন করানো হয়। বহিষ্কৃত সাংসদের মা এসে দরজা খোলেন। সাক্ষীদের উপস্থিতিতে ফ্ল্যাটে প্রবেশ করেন সিবিআইয়ের আধিকারিকেরা। শুরু হয় তল্লাশি। দুপুর ১টা ৪৫ মিনিট নাগাদ ওই ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যায় সিবিআইয়ের দলটি। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার সূত্রে জানা যায়, খালি হাতেই বেরিয়েছেন তাদের আধিকারিকেরা। কোনও কিছু বাজেয়াপ্ত করা হয়নি। তবে কৃষ্ণনগরে মহুয়ার দুই দফতরে এবং করিমপুরে তাঁর ভাড়াবাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে কী পাওয়া গিয়েছে, তা এখনও জানা যায়নি।
মহুয়ার দুই দফতরে হানা
শনিবার দুপুরে কৃষ্ণনগরের সিদ্ধেশ্বরীতলায় যেখানে মহুয়ার সাংসদ কার্যালয় রয়েছে, সেখানে যান সিবিআই আধিকারিকেরা। কৃষ্ণনগর পুরসভার ২২ নম্বর ওয়ার্ডে জনি মোদক নামের এক ব্যক্তির বাড়ি ভাড়া নিয়ে সাংসদ কার্যালয় তৈরি করেন মহুয়া। সাংসদ হওয়ার পর সেখান থেকেই প্রশাসনিক কাজকর্ম পরিচালনা করতেন। শনিবার সিবিআই আধিকারিকেরা যখন ওই বাড়িতে যান, তখন বাড়ির মালিক জনিই দরজা খুলে দেন। এই বাড়ির পিছনে আর একটি বাড়ি থেকে দলীয় কাজকর্ম পরিচালনা করেন মহুয়া। সেই দফতরেও হানা দেয় সিবিআই।
করিমপুরের বাড়িতে সিবিআই
জল্পনা ছিলই। সেই মতো রাত ৮টা ৩৫ নাগাদ মহুয়ার করিমপুরের ভাড়াবাড়িতে যায় সিবিআই। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার একটি সূত্রে জানা যায়, মহুয়ার এক ঘনিষ্ঠকে ডেকে ওই বাড়ির তালা খোলানো হয়। তার পর ভিতরে ঢুকে তল্লাশি চালান এক মহিলা আধিকারিক-সহ ৬ সদস্যের তদন্তকারী দল। সঙ্গে ছিলেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর ১২ জন জওয়ান। রাত ৯টা ৫৮ নাগাদ বেরিয়ে যান সিবিআই আধিকারিকেরা। তল্লাশি চালানোর সময় উপস্থিত ছিলেন করিমপুরে মহুয়ার ‘ছায়াসঙ্গী’ হিসাবে পরিচিত রাজেশ মণ্ডল।
কী বললেন মহুয়া
সিবিআই তল্লাশি নিয়ে সারা দিন মুখ না খুললেও সিবিআই তল্লাশি শেষ হওয়ার মিনিট দুয়েক পর, রাত ১০টায় নিজের এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে একটি পোস্ট করেন মহুয়া। ওই পোস্টে দেখা যায় মহুয়া এবং যাদবপুরের তৃণমূল প্রার্থী সায়নী ঘোষ দূরবিনে চোখ রেখে কিছু দেখার চেষ্টা করছেন। এই ছবি পোস্ট করে বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গিতে মহুয়া লেখেন, “আজ সিবিআই আমার বাড়িতে এবং নির্বাচনী দফতরে এসেছিল। সেখানে তল্লাশি চালানো হয়। কিছুই পায়নি। আমি আর সায়নী এখনও আমাদের বিরুদ্ধে কারা বিজেপি প্রার্থী, তা খুঁজে চলেছি।”
কী বলছে বিরোধী দলগুলি
মহুয়ার পাশে দাঁড়িয়ে কংগ্রেস মুখপাত্র সৌম্য আইচ রায় বলেন, “মহুয়ার সঙ্গে যা হচ্ছে, তা অসাংবিধানিক। আসলে লোকসভায় এক বলিষ্ঠ কণ্ঠকে থামাতে এই কাজ করছে বিজেপি।” বিজেপি মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য অবশ্য মহুয়ার সমালোচনা করে বলেন, “তৃণমূল বলেছিল, মহুয়ার ব্যাপার মহুয়া বুঝে নেবে। তার পর বিষয়টা তৃণমূল কখন বুঝতে শুরু করল, তার উত্তর ওরাই দিতে পারবে।” একই সঙ্গে তাঁর সংযোজন, “এথিক্স কমিটিতে মহুয়ার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। সিবিআই তদন্ত করছে। বিজেপি যেমন সিবিআইকে বলতে পারে না কোথায় তারা তদন্ত করতে যাবে, তেমনই বলতে পারে না, কোথায় তারা তদন্ত করতে যাবে না।”
কী বলল তৃণমূল
তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ বলেন, “মহুয়াকে ভয় পাচ্ছে বিজেপি। এত কিছু করেও কৃষ্ণনগর আসনে জেতা যাবে না বুঝতে পেরেই এই সব কাণ্ড ঘটাচ্ছে তারা।”
মহুয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ
দুবাইয়ের শিল্পপতি দর্শন হীরানন্দানির কাছ থেকে টাকা নিয়ে সংসদে প্রশ্ন করেছেন! এমনই অভিযোগ ওঠে মহুয়ার বিরুদ্ধে। কৃষ্ণনগরের বহিষ্কৃত সাংসদ তথা এ বারে ওই কেন্দ্রেরই তৃণমূল প্রার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ যে, তিনি নিশানা করেছেন শিল্পপতি গৌতম আদানিকে। অভিযোগ, সবটাই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে অস্বস্তিতে ফেলার জন্য। এই অভিযোগ জানিয়ে লোকসভার স্পিকারকে চিঠি দিয়ে মহুয়াকে সাংসদ পদ থেকে বরখাস্ত করার দাবি তোলেন বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে। তার আগে মহুয়ার প্রাক্তন বান্ধব জয় অনন্ত দেহাদ্রাই বিভিন্ন অভিযোগে সিবিআই তদন্তের দাবি জানান। পরে হীরানন্দানি নিজেই হলফনামা দিয়ে জানান, মহুয়ার সংসদের লগ ইন আইডি জেনে তাতে প্রশ্ন টাইপ করতেন তিনি। তবে ঘুষের অভিযোগ মানেননি। নিজের লগ ইন আইডি দেওয়ার কথা স্বীকার করলেও ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ মানেননি মহুয়াও। তিনি অভিযোগ করেন, তাঁর বক্তব্য না শুনেই লোকসভার এথিক্স কমিটি তাঁকে একতরফা ভাবে বহিষ্কারের সুপারিশ করেছে। গত ৮ ডিসেম্বর সেই সিদ্ধান্ত লোকসভায় পাশ হয়ে যায়।