অসুস্থ হলে হাসপাতালে গিয়ে পড়লেই হল। একটা পয়সাও পকেট থেকে লাগবে না। রাজ্য সরকারি কর্মীদের এ হেন সুবিধা দিতে চালু করা ‘ক্যাশলেস’ চিকিৎসা প্রকল্পটি কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে বছরখানেকের মধ্যেই। পরিষেবা বন্ধ করে দিচ্ছে একের পর হাসপাতাল। অভিযোগ একটাই— নবান্ন টাকা দিচ্ছে না।
আগে সরকারি হেল্থ স্কিমে ছিল শুধু ‘রি-ইমবার্সমেন্ট’ ব্যবস্থা। মানে চিকিৎসার খরচ পরে পুষিয়ে দেওয়া। খরচের বিল সরকারের ঘরে জমা দিলে সংশ্লিষ্ট কর্মী টাকাটা ফেরত পাবেন। এর পাশাপাশি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ‘ক্যাশলেস’ চালু করেছে ২০১৪-র নভেম্বরে। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, খরচ ১ লক্ষ টাকার মধ্যে হলে হাসপাতাল বিল পাঠিয়ে দেবে কর্মীর দফতরে। অর্থ দফতরের অনুমতি নিয়ে দফতর সরাসরি বিল মেটাবে।
কিন্তু বছর গড়াতে না গড়াতেই উদ্যোগের হাঁড়ির হাল! হাসপাতালগুলোর অনুযোগ, বিল নিয়মমতো পাঠানো সত্ত্বেও সরকার মাসের পর মাস টাকা মেটাচ্ছে না। তাগাদা বৃথা যাচ্ছে। বকেয়ার বহর দিন দিন বাড়ছে। ‘‘এমতাবস্থায় পরিষেবা বন্ধ করা ছাড়া উপায় কী?’’— পাল্টা প্রশ্ন তুলছেন বিভিন্ন হাসপাতালের কর্তারা।
অসন্তোষ দানা বেঁধেছে সরকারের অন্দরেও। কর্মীদের বড় অংশের প্রশ্ন, মেলা-উৎসব-ক্লাব অনুদানের মতো বিবিধ খয়রাতিতে কোষাগার উজাড় করতে পারলে কর্মীদের হাসপাতালের বিল মেটাতে এত দেরি কেন? যা শুনে প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত অর্থ দফতরের যুগ্মসচিব শিউকুমার রামের যুক্তি, ‘‘টাকা যথেষ্ট আছে। কিন্তু একটা নতুন প্রকল্প পুরোমাত্রায় চালু করতে সময় লাগে। প্রক্রিয়াগত কিছু কারণে দেরি হচ্ছে।’’
সেটা কী রকম?
অর্থ ও স্বাস্থ্য-সূত্রের বক্তব্য, হাসপাতাল কর্মীর দফতরে বিল পাঠাবে, সেই বিল অর্থের অনুমোদন পাবে, তার পরে টাকা ছাড়া হবে— লালফিতের ফাঁসে এত পর্ব চুকতেই বহু সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। কোনও বিল নিয়ে অর্থ দফতর প্রশ্ন তুললে তো আরও দেরি। কারণ তা আবার স্বাস্থ্য দফতরে পাঠানো হচ্ছে। ডাক্তারদের কমিটি বানিয়ে সেটি যাচাই করা হচ্ছে। যদিও সদ্য প্রাক্তন স্বাস্থ্য-সচিব (অধুনা স্বরাষ্ট্র-সচিব) মলয় দে’র কথায়, ‘‘যাচাইয়ের কাজে ন্যূনতম যা সময় দরকার, তা-ই নেওয়া হয়। বাকিটা অর্থ দফতর বলতে পারবে।’’ অর্থ কী বলছে?
অর্থের এক অন্যতম কর্তা জানাচ্ছেন, ২০১৪-র নভেম্বরে ক্যাশলেস প্রকল্প চালু হলেও রাজ্যের অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেলের আপত্তিতে ২০১৫-র মার্চ পর্যন্ত হাসপাতালগুলোর বিল মেটানো যায়নি। পরিণামে বিস্তর বকেয়া জমে যায়। তা ছাড়া হেল্থ স্কিমে অর্থ বরাদ্দ রয়েছে রি-ইমবার্সমেন্ট ও ক্যাশলেস মিলিয়ে। এবং স্কিমের সিংহভাগ টাকা রি-ইমবার্সমেন্টের পিছনেই বেরিয়ে যাচ্ছে বলে ওঁর দাবি।
সরকারি তথ্যানুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবর্ষে হেল্থ স্কিমে ৯৫ কোটি টাকার বেশি খরচ হয়েছে। বেশিটাই রি-ইমবার্সমেন্টে। ২০১৫ সালে ক্যাশলেস চিকিৎসা সংক্রান্ত ছ’হাজারটি বিল অর্থ দফতরে জমা পড়েছে। মেটানো হয়েছে সাড়ে তিন হাজারের কিছু বেশি। বাকি পুরোটাই বকেয়া।
এমন যে হতে পারে, বিভিন্ন বড় হাসপাতালের মাথারা তা আগে আঁচ করেছিলেন। তাই ওঁরা সরকারের ডাকে সাড়া দেননি। প্রকল্পটি গোটা রাজ্যের হলেও তাতে সামিল হয়েছিল মূলত কলকাতার গুটিকয় হাসপাতাল, যাদের এখন পরিতাপের অন্ত নেই। তারা পরিষেবা বন্ধ করে দিয়েছে। বাইপাসের এমন এক হাসপাতালের অভিযোগ, সাত-আট মাস আগে ক্যাশলেস চালু করে রাজ্যের কাছে কাছে তাদের পাওনা হয়েছে অন্তত দু’কোটি টাকা। বাইপাসের আর একটি হাসপাতালেরও দু’কোটির উপর পাওনা বলে অভিযোগ। বিল বাকি থাকায় নিউ আলিপুর, বাঘাযতীন, নারায়ণপুর ও বোলপুরের একটি করে হাসপাতালও ক্যাশলেসে দাঁড়ি টেনেছে।
তবে চিকিৎসা মহলের ভিতরের খবর, বকেয়ার চাপে আরও কিছু হাসপাতালের নাভিশ্বাস উঠলেও তারা পরিষেবা বন্ধ করতে পারছে না স্রেফ শাসকদলের চাপে। যেমন, ভিআইপি রোডের একটি হাসপাতালের পাওনা ৮০ লক্ষ ছাড়িয়েছে। অথচ ক্যাশলেস চালিয়ে যেতে হচ্ছে, কারণ ।পরিচালন সমিতিতে রয়েছেন তৃণমূলের একাধিক মন্ত্রী। মধ্য কলকাতার একটি নার্সিংহোম সরকারের সঙ্গে ‘সুসম্পর্ক’ বজায় রাখার তাগিদে কোটি টাকা বকেয়া সত্ত্বেও প্রকল্প ছাড়তে পারছে না। সরকারের থেকে এক টাকায় জমি পাওয়া আর একটি হাসপাতালও তা-ই। যদিও ক্যাশলেস স্কিমে রোগী ভর্তির সংখ্যা তারা অর্ধেক করে দিয়েছে।
সব দেখেশুনে নবান্নে অবশ্য বিশেষ হেলদোল নেই। ফলে হয়রানি বাড়ছে কর্মীদের।
(চলবে)