রাতের অন্ধকারে রোজই নাকি চুপি চুপি হস্টেল ছেড়ে পালান ভারতীয় ছাত্রটি। আবার শেষ রাতে ফিরে সকালে কলেজে ক্লাস করেন। খবর পেয়ে এক রাতে ব্রিটিশ সুপার নিজে দেখলেন বাঙালি তরুণের কাণ্ড। তার পর পিছু নিলেন। যা দেখলেন, তাতে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল।
সুপার দেখলেন ওই তরুণ হস্টেল ছেড়ে চলে যাচ্ছেন খিদিরপুর ডকে। সারা রাত সেখানে মালবাহকের কাজ করছেন। তার পর হস্টেলে ফিরে কলেজের ক্লাস করতে যাচ্ছেন। ব্রিটিশ সুপার অবাক হয়ে গেলেন পড়াশোনার জন্য বাঙালি তরুণের অধ্যবসায় দেখে। তিনি জানতেন না, জন্মের পর থেকে এ ভাবেই আজন্ম কষ্ট সহ্য করে এসেছেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত।
‘নরেন্দ্রনাথ দত্ত’ বলতেই যে বিশ্ববরেণ্য বাঙালির নাম মনে পড়ে, সেই স্বামী বিবেকানন্দের থেকে বয়সে ২১ বছরের ছোট ছিলেন এই নরেন্দ্রনাথ। ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দের ২১ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্ম পূর্ববঙ্গের কুমিল্লা জেলার শ্রীকাইল গ্রামে। খুব ছোটবেলায় মাকে হারান। বাবা কৃষ্ণকুমার দত্ত ছিলেন চট্টগ্রাম কলেজে সামান্য বেতনের সংস্কৃত শিক্ষক। দুই সন্তানকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে গ্রাসাচ্ছাদন জোগাড় করতে গিয়ে তাঁর নাভিশ্বাস উঠত। তখন স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি ভবিষ্যতে তাঁর ছেলের হাতেই প্রতিষেধক তৈরির ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সাক্ষী থাকবে সারা দেশ।
পড়াশোনার খরচ জোগাড় করতে মাত্র ৭-৮ বছর বয়স থেকে মাঠে ভাগচাষির কাজ করতেন নরেন্দ্রনাথ। তার পর আংশিক সময়ের কাজ নিলেন মুদির দোকানে। তার পরেও মাইনর স্কুলের পড়াশোনায় মাসিক ২ টাকা করে বৃত্তি পেতেন। সেখান থেকে তিনি যান কুমিল্লা জেলা স্কুলে। পড়াশোনায় আগাগোড়া মেধাবী নরেন্দ্রনাথ জলপানি পেতেন জেলা স্কুলেও।
পাশাপাশি, তিনি অন্যত্রও উপার্জন শুরু করেছিলেন। নিজের এবং আশেপাশের গ্রাম থেকে তরকারি কিনে নিয়ে যেতেন কুমিল্লার বাজারে। সেখানে বসে বিক্রি করতেন আনাজপাতি। স্কুলের পরে কুমিল্লার ধনীদের বাড়ির বাগানে মালির কাজ করে তবেই ফিরতেন বাড়িতে। ১৯০৯ সালে এফ এ পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান পান তিনি। ডাক্তারি পড়ার জন্য পাড়ি দেন কলকাতা। অবিভক্ত ভারতের তৎকালীন রাজধানীতে এসে তিনি আরও অর্থকষ্টের মুখে পড়লেন। বৃত্তি যা পান, সেই টাকা খরচ হয়ে যেত পড়াশোনার পিছনেই। নিজের থাকাখাওয়ার খরচ জোটাতে তিনি চোখে অন্ধকার দেখলেন।
মাসে ৫ টাকা বেতনের চুক্তিতে আংশিক কাজ নিলেন চুনীলাল বসুর ল্যাবরেটরিতে। কিন্তু সেখানে মনোমালিন্যের জেরে বেশিদিন কাজ করতে পারেননি। এর পর এক মারোয়াড়ি ব্যবসায়ীর গদিতে খাতা লেখার কাজ করলেন। কিন্তু সেখানে কম পারিশ্রমিকের জন্য বেশিদিন কাজ করতে পারেননি। সেই কাজ ছেড়ে অবশেষে কাজ নেন খিদিরপুর ডকে।
ডাক্তারি কোর্সের চূড়ান্ত পরীক্ষার পরে তাঁর শিক্ষক কর্নেল কালভার্টের সুপারিশে তিনি কাজ পান প্রেসিডেন্সি জেনারেল হাসপাতালে। সেখানে কিছু দিন থাকার পরে তৎকালীন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিসেস-এর ইমার্জেন্সি কমিশনে তিনি যোগ দেন লেফটেন্যান্ট হিসেবে। তাঁর কর্মক্ষেত্র ছিল ইরাকে ইউফ্রেটিস নদীর তীরের সেনা হাসপাতাল।
কাজের ক্ষেত্রে তিনি ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন। সেনা হাসপাতালের চাকরি ছেড়ে তিনি ভারতে ফিরে আসেন ১৯২৫ সালে। কারণ চাকরি করতে তাঁর আর ভাল লাগছিল না। ছাত্রজীবনে যেদিন থেকে আনাজপাতি বিক্রি করে পড়াশোনা করেছিলেন, সেদিন থেকেই ব্যবসা করার ইচ্ছে জাঁকিয়ে বসে ছিল তাঁর মনে। ভারতে ফিরে চাকরিতে যোগ না দিয়ে কৃষ্ণনগরে ৭০-৮০ বিঘা জমি ইজারা নিলেন। সেখানে ফলের বাগানের পাশাপাশি দীঘিতে মাছের চাষ করতেন। তাঁর কথায় ভাইও চাকরি ছেড়ে দাদার ব্যবসায় যোগ দিয়েছিলেন।
এই সময় তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় বিধানচন্দ্র রায়ের। তারও বেশ কয়েক বছর আগে বিধানচন্দ্র রায়, নীলরতন সরকার, কৈলাসচন্দ্র বসু এবং চারুচন্দ্র বসু মিলে তৈরি করেছিলেন সিরাম তৈরির লক্ষ্যে বেঙ্গল ইমিউনিটি প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি। কিন্তু প্রতিষ্ঠাতাদের ব্যস্ততায় বিঘ্নিত হচ্ছিল সংস্থার কাজ। বিধানচন্দ্র রায় চেয়েছিলেন সংস্থাটি নতুন ভাবে শুরু হোক। তিনি সংস্থার দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেন নরেন্দ্রনাথ দত্তকে।
সংস্থাটি প্রথমে ছিল কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে। তার পর ঠিকানা বদলে চলে আসে প্রিন্সেপ স্ট্রিটে। বিধানচন্দ্র রায়ের সহপাঠী বন্ধু চিকিৎসক অমূল্যচরণ চক্রবর্তীও এই সংস্থার হাল ফেরাতে পারেননি। নরেন্দ্রনাথ যখন সংস্থার দায়িত্ব নেন, তখন এর কোষাগারে পড়ে মাত্র ৪১ টাকা। বাজারে দেনা ৩৪ হাজার টাকার বেশি। দায়িত্ব নেওয়ার পরে নরেন্দ্রনাথ প্রথমেই ঠিক করলেন ওষুধ তৈরি থেকে কেনা-বেচা— সব দিকেই নজর রাখবেন তিনি নিজে।
তখন সংস্থার অফিস ধর্মতলা স্ট্রিটে। সংস্থার আস্তাবল ছিল যাদবপুরে। সেখানেই গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় ঘোড়া রাখা থাকত। তাদের দেহ থেকে রক্ত নেওয়া হত অ্যান্টি ভেনম প্রতিষেধক তৈরির জন্য। ‘অ্যান্টি ভেনম’ বা সাপের বিষের ওষুধ তৈরির পাশাপাশি ‘অ্যান্টি র্যাবিস’ ওষুধ তৈরির ক্ষেত্রেও এই সংস্থার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। নরেন্দ্রনাথ দায়িত্ব গ্রহণের পরে দ্রুত অবস্থার পরিবর্তন হয় এই সংস্থার। ১৬ মাসের মধ্যে সংস্থার ৩৪ হাজার টাকা দেনা তো শোধ তো হয়েই যায়। সেইসঙ্গে আরও ১ হাজার টাকা উদ্বৃত্ত থাকে। এই সময়পর্বের জন্য নরেন্দ্রনাথ কোনও পারিশ্রমিক নেননি।
২ বছরের মধ্যে সংস্থার জন্য কলকাতার উপকণ্ঠে ২৫ বিঘা জমির উপর দোতলা বাড়ি এবং বাগান কেনেন তিনি। দেশের বিভিন্ন জেলায় নিয়োগ করেন স্টকিস্ট এবং প্রতিনিধি। বৃদ্ধি পায় ব্যবসা। এর গবেষণাগারে যোগ দেন বিভিন্ন দেশের বৈজ্ঞানিকরা। ১৯৪৬ সালে লোয়ার সার্কুলার রোডে ৫ বিঘা জমির উপর বড় বাড়িতে সংস্থার অফিস তৈরি করেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পথপ্রদর্শক এই সংস্থা আরও শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে। বরাহনগরে কারখানা এবং ২৭ বিঘা জমিতে ৩টি আস্তাবল তৈরি করা হয়। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোডে আড়াই বিঘা জমির উপর তৈরি হয় গবেষণাকেন্দ্র। পাশাপাশি দেহরাদূন এবং ঠানেতেও সংস্থার কারখানা এবং আস্তাবল তৈরি করা হয়।
মোট ২০ রকমের ওষুধ তৈরি করত বেঙ্গল ইমিউনিটি। এছাড়াও কেমিস্ট্রি, বায়োকেমিস্ট্রি, নিউট্রিশন, ফিজিয়োলজি, ফার্মাকোলজি-সহ বিভিন্ন বিষয়ের ল্যাবরেটরি তৈরি হয়। অন্যান্য ব্যবসাতেও ধীরে ধীরে পা রাখে ‘বেঙ্গল ইমিউনিটি’। ওষুধ এবং চিকিৎসাবিজ্ঞান ছাড়াও নরেন্দ্রনাথের কাজের পরিধি ছিল আরও বিস্তৃত। গভীর সমুদ্রে ধীবরদের যাতে মাছ ধরার সুবিধে হয় তার জন্য ভাবনাচিন্তা করতেন তিনি। দেশীয় প্রযুক্তিতে উন্নত ট্রলার তৈরির জন্য স্থাপন করেছিলেন ‘ইন্ডিয়ান ট্রলার কোম্পানি’।
র্যাডিক্যাল ইনসিওরেন্স কোম্পানি, ইন্ডিয়ান রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ভারতী প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিশিং, নবশক্তি নিউজপেপার্স কোম্পানি-সহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত। বিধানচন্দ্র রায়ের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক বজায় ছিল জীবনভর। মন্ত্রিসভায় যোগ দেওয়ার জন্য তাঁকে আমন্ত্রণও জানান বাংলার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত বিধানচন্দ্র রায়। কিন্তু সেই অনুরোধ বিনীতভাবে ফিরিয়ে দেন নরেন্দ্রনাথ। সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে থেকে জনকল্যাণে কাজ করে যাওয়াই ছিল তাঁর জীবনচর্যা।
অনাড়ম্বর জীবন কাটানো এই কর্মযজ্ঞের পুরোহিত প্রয়াত হন ১৯৪৯ সালের ৭ এপ্রিল। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর আগের মুহূর্ত অবধি তিনি কাজ করে গিয়েছেন। চলে যাওয়ার দিনও সকাল থেকে দুপুর অবধি কাজ করে গিয়েছেন বেঙ্গল ইমিউনিটি কোম্পানি লিমিটেডের তৎকালীন ম্যানেজিং ডিরেক্টর নরেন্দ্রনাথ দত্ত। বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। তাঁর হাতে নতুন জীবন পাওয়া সংস্থা ‘বেঙ্গল ইমিউনিটি’ সাহায্য করেছিল যুগান্তকারী টিকা আবিষ্কারের ক্ষেত্রে। গুরুত্বপূর্ণ ড্রাগ যাতে সুলভে বাজারে পাওয়া যায়, সে দিকেও নজর ছিল এই সংস্থার। ক্রান্তীয় এলাকার রোগে কার্যত ধন্বন্তরি হিসেবে গুরুত্ব পাওয়া বেঙ্গল ইমিউনিটির অ্যান্টি টক্সিনের কার্যকারিতা মুগ্ধ ও বিস্মিত করত ইউরোপীয়দেরও। বেঙ্গল ইমিউনিটিই প্রথম বাণিজ্যিক ভাবে বাজারে এনেছিল সিরাম।
বাংলা তথা বাঙালির গর্ব এই সংস্থার দুর্দিন চরমে ওঠে ১৯৯০ সালের পরবর্তী সময়ে। সেই সময় অ্যান্টি ভেনম তৈরির জন্য ঘোড়াদের গবেষণাগারে ব্যবহারের প্রশ্নে প্রতিবাদে সোচ্চার হন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা পশুপ্রেমী মেনকা গাঁধী। এই প্রশ্নে মত, পাল্টা মত, প্রতিবাদ, পাল্টা প্রতিরোধে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। কিন্তু শেষ অবধি ‘বেঙ্গল ইমিউনিটি’-র চিরতরে বন্ধ হয়ে যাওয়া আটকানো যায়নি। ২০০৩ সালের জুন মাসে বরাবরের জন্য গর্বের এই সংস্থা তালাবন্দি হয়ে পড়ে।
তবে এই সংস্থার বাইরে ক্যাপ্টেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত ছড়িয়ে আছেন অন্যত্রও। নিজের ছাত্রাবস্থার কষ্টের কথা মনে রেখে জন্মস্থান কুমিল্লার শ্রীকাইল গ্রামে স্কুল এবং কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। কিন্তু ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পরে স্কুলটি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। খবর পেয়ে নরেন্দ্রনাথ নিজে শ্রীকাইলে যান। নিজের জীবনের সর্বস্ব দিয়ে তৈরি করেন স্কুলের ট্রাস্টিবোর্ড। যাতে ভবিষ্যতে এই প্রতিষ্ঠানের যাত্রাপথ সুগম থাকে।
শুধু নিজের তৈরি স্কুলের যাত্রাপথই নয়। নরেন্দ্রনাথের আজীবন কর্মযজ্ঞের ফলস্বরূপ মসৃণ হয়েছিল মন্বন্তরে না মরা মারী নিয়ে ঘর করা বাঙালি তথা ভারতবাসীর জীবন। অথচ আজ, অতিমারির প্রতিষেধক তৈরির আবহে বিস্মৃতির আড়ালে চলে গিয়েছেন প্রতিষেধক গবেষণার ক্ষেত্রে পথ দেখানো এই প্রাণপুরুষ। (ঋণস্বীকার: ডঃ পার্থ চট্টোপাধ্যায়) (ছবি: আর্কাইভ, শাটারস্টক এবং সোশ্যাল মিডিয়া)