Recruitment Scam

‘দুর্নীতির পিছনে কার মাথা খুঁজে পাচ্ছেন না!’

বিচারপতির নির্দেশ, ২৯ অগস্টের মধ্যে সিবিআই এবং ইডিকে বিস্তারিত রিপোর্ট আদালতে পেশ করতে হবে। এই দুর্নীতিতে কারা লাভবান হয়েছেন, তা জানাতে হবে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ জুলাই ২০২৩ ০৬:৫৭
Share:

বিচারপতি অমৃতা সিংহ। —ফাইল চিত্র।

নিয়োগ দুর্নীতির ‘মাথা’ কে, সম্প্রতি বার বার সেই প্রশ্ন শোনা গিয়েছে কলকাতা হাই কোর্টের অলিন্দে। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় প্রথম সেই প্রশ্ন তোলেন। তাঁর এজলাস থেকে মামলা সরে আসে বিচারপতি অমৃতা সিংহের কাছে। শুক্রবার সেই একই ‘মাথা কে’ প্রশ্ন তুললেন তিনিও।

Advertisement

প্রাথমিকে নিয়োগ দুর্নীতির মামলার শুনানিতে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার কৌঁসুলিদের উদ্দেশে বিচারপতি সিংহের প্রশ্ন, ‘‘আপনারা এই দুর্নীতির পিছনে মূল চক্রী বা কার মাথা রয়েছে, তা খুঁজে বার করতে পারছেন না! যত দিনে তা বার করবেন, তখন কারও কাজে লাগবে না।’’ তাঁর পর্যবেক্ষণ, তদন্ত রিপোর্টে যে তথ্য এবং সংখ্যা উঠে আসছে, তা হজম করা কঠিন। এই চক্রের পিছনে হয়তো একাধিক লোক থাকতে পারেন। অনন্ত সময় ধরে যে তদন্ত চলতে পারে না, সে কথাও কার্যত স্পষ্ট করে দিয়েছেন বিচারপতি সিংহ।

বিচারপতির নির্দেশ, ২৯ অগস্টের মধ্যে সিবিআই এবং ইডিকে বিস্তারিত রিপোর্ট আদালতে পেশ করতে হবে। এই দুর্নীতিতে কারা লাভবান হয়েছেন, তা জানাতে হবে। বিশেষত কারা টাকা দিয়ে চাকরি পেয়েছেন এবং তাঁরা এখনও প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতা করছেন কি না, সেই তালিকা জানাতে হবে হাই কোর্টকে।

Advertisement

প্রাথমিকে নিয়োগে এখনও পর্যন্ত ৩৫৪ কোটি টাকার বেশি লেনদেনের কথা জানা গিয়েছে বলে ইডির দাবি শুনে বিচারপতি বলেন, ‘‘এত টাকার সন্ধান পাওয়ার পরেও এই চক্রের কিংপিন বা মাথার খোঁজ পাচ্ছেন না!’’ তদন্তের অগ্রগতি নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করেন তিনি। শেষ কবে ধরপাকড় হয়েছে, সেই প্রশ্নও কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের উদ্দেশে করেন বিচারপতি সিংহ। ইডির কৌঁসুলি দাবি করেছিলেন, তাঁরা যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজ করছেন। যদিও বিচারপতির পর্যবেক্ষণ, ‘‘যুদ্ধকালীন তৎপরতা একেবারেই নয়। গতি আরও বাড়ানো প্রয়োজন।’’

পাশাপাশি, প্রাথমিকে নিয়োগের তদন্ত থেকে যে পুর-নিয়োগ দুর্নীতির কথা উঠে এসেছে, সেই তদন্ত কোন অফিসারেরা করছেন, তা-ও সিবিআইয়ের কাছে জানতে চেয়েছেন বিচারপতি। নিয়োগ দুর্নীতির মতো পুর-নিয়োগের তদন্তেও আদালতের নজরদারিতে বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠন করা হবে কি না, তা পরে বিবেচনা করবে কোর্ট।

প্রাথমিকে নিয়োগ মামলায় প্রাক্তন তৃণমূল যুব নেতা (অধুনা বহিষ্কৃত) কুন্তল ঘোষকে গ্রেফতার করেছেন তদন্তকারী অফিসারেরা। কুন্তল প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগারে বসে চিঠি লিখে অভিযোগ করেছিলেন, তাঁর মুখ দিয়ে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম বলানোর জন্য ইডি এবং সিবিআই নির্যাতন করেছে। এ ব্যাপারে দীর্ঘ আইনি বিতর্ক হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে প্রাথমিক নিয়োগে সৌমেন নন্দী এবং রমেশ মালিক নামে দুই চাকরিপ্রার্থীর মামলা বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাস থেকে বিচারপতি সিংহের এজলাসে পাঠানো হয়েছে। যদিও সেখানেও স্বস্তি পাননি অভিষেক এবং কুন্তল। অভিষেককে সুপ্রিম কোর্টও রক্ষাকবচ দেয়নি। ফলে মামলাটি ফের কলকাতা হাই কোর্টে ফিরে এসেছে।

এ দিন কেন্দ্রের ডেপুটি সলিসিটর জেনারেল বিল্বদল ভট্টাচার্য বিচারপতি সিংহের এজলাসে সিবিআইয়ের রিপোর্ট জমা দেন। তিনি জানান, চিকিৎসক বা অন্য কোনও পক্ষই কুন্তলের উপরে নির্যাতনের কথা বলতে পারেননি। কুন্তলের স্ত্রী এবং আইনজীবীর বয়ান পরস্পরবিরোধী বলেও তিনি জানান। একই সঙ্গে বিল্বদল কোর্টে বলেছেন, সংশোধনাগারের সিসিটিভি-র ফুটেজ ১৮০ দিন সংরক্ষণ করার কথা থাকলেও, প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগার তা করেনি। কেন্দ্রের আর এক ডেপুটি সলিসিটর জেনারেল ধীরাজ ত্রিবেদী ইডির রিপোর্ট জমা দিয়ে বলেন, প্রাথমিকে নিয়োগে ৩৫৪ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়েছে বলে এখনও পর্যন্ত জানা গিয়েছে। সেই টাকা বিভিন্ন সম্পত্তিতে ঢালা হয়েছে। বাংলা সিনেমার জগতেও টাকা লগ্নি করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১২৬ কোটি টাকার সন্ধান ইডি পেয়েছে।

প্রসঙ্গত, এর আগে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় একাধিক বার সিবিআই এবং ইডির তদন্তের গতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। ‘জীবদ্দশায়’ তিনি এই তদন্তের শেষ দেখতে পাবেন কি না, সেই আশঙ্কাও এজলাসে বসে করেছিলেন তিনি। অনেকেই মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ন’বছর পরেও সারদা কেলেঙ্কারির তদন্ত শেষ করতে পারেনি সিবিআই। নারদ কাণ্ডের তদন্তও কার্যত অথৈ জলে।

এ দিন চাকরিপ্রার্থী রমেশ মালিকের আইনজীবী সুদীপ্ত দাশগুপ্ত এবং বিক্রম বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, এই মামলা দু’টি ভাগে বিভক্ত। একটি নিয়োগ দুর্নীতি এবং অন্যটি কুন্তলের চিঠি। কুন্তলের ঘটনায় সিবিআই রিপোর্ট দিয়েছে। কিন্তু চাকরি দুর্নীতি নিয়ে তদন্তকারীদের কাছে রিপোর্ট চাওয়া হোক। কারা টাকা দিয়েছেন এবং সেই টাকা কাদের কাছে পৌঁছেছে, তা জানতে চাওয়া হোক। এটা সবার জানা উচিত। চাকরিপ্রার্থী সৌমেন নন্দীর আইনজীবী ফিরদৌস শামিমের বক্তব্য, ‘‘সুপ্রিম কোর্টে কেন্দ্রের অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল বলেছেন, নিয়োগ দুর্নীতিতে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের যোগ তাঁরা পেয়েছেন। তা ছাড়াও, এই মামলায় যে টাকা লেনদেনের কথা বলা হচ্ছে, তা কারা দিয়েছেন? সেই তালিকা তদন্তকারীরা সামনে আনুক। টাকা দিয়ে চাকরি পাওয়া ব্যক্তিরা কি এখনও স্কুলে পড়াচ্ছেন? সরকারি কোষাগার থেকে বেতন নিচ্ছেন?... রাজ্য সরকারকেই বেআইনি ভাবে চাকরি পাওয়া লোকদের খুঁজে বার করতে হবে।’’

এ দিন তদন্ত রিপোর্টের কিছু অংশ বিচারপতি নির্দেশের প্রতিলিপিতে উল্লেখ করেন। তদন্ত রিপোর্টের অংশ যাতে নির্দেশনামায় উল্লেখ না করা হয়, সে ব্যাপারে আর্জি জানান কেন্দ্রীয় সরকারের আইনজীবীরা। তাঁদের মতে, এর ফলে তদন্তে অসুবিধা হবে। কোথায় তল্লাশি-হানা হতে পারে তা অভিযুক্তেরা আগেভাগে বুঝতে পারবেন। কিন্তু সেই যুক্তি মানতে চাননি বিচারপতি সিংহ। তিনি বলেন, ‘‘যেগুলি উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলি নানা জায়গাতেই প্রকাশিত। তা ছাড়া, আপনারা (তদন্তকারী সংস্থা) যে কাজ করছেন, তা লোকে জানুক।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement