বাঁ দিক থেকে, বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, বিচারপতি সৌমেন সেন, প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম এবং বিচারপতি রাজাশেখর মান্থা। —ফাইল চিত্র।
মঙ্গলবারের কলকাতা হাই কোর্ট ঘটনাবহুল। দুই বিচারপতির বেনজির সংঘাত নিয়ে ইতিমধ্যেই সারা দেশে শোরগোল পড়ে গিয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পদক্ষেপ করে হাই কোর্টের হাত থেকে সরিয়ে দিয়েছে মেডিক্যালে ভর্তি মামলা। এই পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার দুই বিচারপতির সংঘাত নিয়ে মুখ খুলেছেন হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম স্বয়ং। অন্য দিকে, একটি বিচারাধীন মামলা থেকে হঠাৎ সরে দাঁড়িয়েছেন বিচারপতি সৌমেন সেন। যার ফলে চাকরিপ্রার্থীরা হতাশ। মামলা আরও দীর্ঘায়িত হবে বলে আশঙ্কা তাঁদের। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের হাত থেকে মঙ্গলবার সরিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রাথমিকে নিয়োগের সমস্ত মামলা। ওই মামলাগুলি পাঠানো হয়েছে বিচারপতি রাজাশেখর মান্থার এজলাসে।
বিতর্কের সূত্রপাত মেডিক্যালে ভর্তি মামলা নিয়ে। ওই মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। বিচারপতি সেনের ডিভিশন বেঞ্চ সেই নির্দেশ খারিজ করে দেয়। তার পর ওই বিচারপতির বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ তোলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। ‘ত্রুটি’ উল্লেখ করে ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশ তিনি খারিজই করে দিয়েছিলেন। তদন্ত চালিয়ে যেতেও বলেছিলেন সিবিআইকে। এর পর সুপ্রিম কোর্ট মামলায় হস্তক্ষেপ করে। মেডিক্যালে ভর্তি সংক্রান্ত সমস্ত মামলা শীর্ষ আদালত নিজের হাতে তুলে নেয়।
বিচারপতিদের মধ্যে এই বেনজির সংঘাতের আবহে মঙ্গলবার হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি শিবজ্ঞানম জানান, তিনি লজ্জিত। দুপুরে এজলাস ছেড়ে উঠে যাওয়ার সময় এ বিষয়ে মন্তব্য করেন তিনি। জানান, এই পরিস্থিতির প্রভাব পড়তে পারে সাধারণ মানুষের উপর। তাই দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলছে। ওই সময়ে এজলাসের সরাসরি সম্প্রচার বন্ধ ছিল। এর পরে উচ্চ প্রাথমিকের একটি মামলা বিচারপতি সেন এবং বিচারপতি উদয় কুমারের ডিভিশন বেঞ্চে ওঠে। আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় সেখানে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গ তোলেন। সে বিষয়ে কোনও কথা শুনতে চাননি বিচারপতি সেন। তিনি জানান, তিনি সব বিচারপতিকেই শ্রদ্ধা করেন। এই সংক্রান্ত বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চান না। এর পরেই উচ্চ প্রাথমিকের ওই মামলাটি থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা জানান বিচারপতি সেন।
বিচারপতি সেনের মামলা ছেড়ে দেওয়ার খবর পেয়েই হাই কোর্টের প্রধান ফটকের বাইরে জড়ো হতে শুরু করেন চাকরিপ্রার্থীরা। বেশ কিছু ক্ষণ তাঁদের বিক্ষোভ চলে। চাকরিপ্রার্থীদের বক্তব্য, বিচারপতিদের মধ্যেকার সংঘাতের ফল তাঁদের ভুগতে হচ্ছে। তাঁদের মামলা বার বার বেঞ্চ বদলের কারণে অহেতুক দীর্ঘায়িত হচ্ছে। পুলিশ গিয়ে বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে।
উচ্চ প্রাথমিকের মামলা থেকে বিচারপতি সেনের সরে যাওয়ার দিনই বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের হাত থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রাথমিকের নিয়োগ সংক্রান্ত যাবতীয় মামলা। বিচারপতি মান্থার এজলাসে ওই মামলাগুলির শুনানি হবে বলে জানানো হয়েছে প্রধান বিচারপতির নির্দেশনামায়। পরিবর্তে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় শুনবেন শ্রম এবং শিল্প আইন সংক্রান্ত মামলাগুলি। এ ছাড়া শিক্ষা মামলায় গ্রেফতারি সংক্রান্ত কিছু মামলা থাকবে তাঁর হাতে।
দুই বিচারপতির সংঘাত
কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি সৌমেন সেনের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ করেছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। নির্দেশনামায় তিনি জানিয়েছিলেন, বিচারপতি অমৃতা সিংহকে এজলাসের সরাসরি সম্প্রচার বন্ধ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন বিচারপতি সেন। দু’টি নিয়োগ সংক্রান্ত মামলা খারিজ করতেও বলেছিলেন তিনি। এমনকি, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বিচারপতি সেন তাঁকে বিরক্ত না করার পরামর্শও দিয়েছিলেন বিচারপতি সিংহকে। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের অভিযোগ, ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য এই ধরনের নির্দেশ দিচ্ছেন বিচারপতি সেন। দেশের প্রধান বিচারপতির দৃষ্টিও আকর্ষণ করেছিলেন তিনি।
সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপ
কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতিদের এই সংঘাত প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টে শুনানি হয়। মেডিক্যালে ভর্তি সংক্রান্ত সব মামলা হাই কোর্ট থেকে সরিয়ে নেয় শীর্ষ আদালত। গত সোমবার প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের বিশেষ বেঞ্চ জানিয়েছে, এই মামলায় সব পক্ষকে হলফনামা জমা দিতে হবে। তিন সপ্তাহ পরে পরবর্তী শুনানি হবে।
‘আমি লজ্জিত, দুঃখিত’
হাই কোর্টের বিচারপতিদের বেনজির সংঘাত প্রসঙ্গে মঙ্গলবার মুখ খোলেন হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি শিবজ্ঞানম। তিনি বলেন, ‘‘আইনের এই মন্দির থেকে এটা আশা করা যায় না। এটা দেশের ঐতিহ্যশালী হাই কোর্ট। এই অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সাধারণ মানুষের উপর প্রভাব ফেলবে। আমরা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার সব রকম চেষ্টা করছি। আশা করছি, পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক হবে।’’ সরাসরি সম্প্রচার বন্ধ থাকাকালীন এই মন্তব্য করেছেন বিচারপতি।
কী বললেন বিচারপতি সেন
যাঁকে নিয়ে এত বিতর্ক, সেই বিচারপতি সেনও এ প্রসঙ্গে মুখ খুলেছেন মঙ্গলবার। তবে তিনি বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গে কোনও কথা বলতে বা শুনতে রাজি হননি। উচ্চ প্রাথমিকের মামলা তাঁর এজলাসে উঠলে আবেদনকারীদের আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় সম্পর্কে কিছু বলতে চান। তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বিচারপতি সেন বলেন, ‘‘এ সব নিয়ে আমি কিছু বলব না। যথেষ্ট হয়েছে। এই আদালত অপমানিত হয়েছে। সংবাদমাধ্যমে বলার অধিকার সকলের রয়েছে। বিচারপতির কাজ নির্দেশ দেওয়া। আমার কিছুই বলার নেই। কোনও মামলার প্রতি আমার বিশেষ আনুগত্য নেই। বিষয়টি নিয়ে আমার কিছুই বলার নেই। তাই দয়া করে ওই বিষয়ে কিছু বলবেন না।’’
‘সকলকে শ্রদ্ধা করি’
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় প্রসঙ্গে বিচারপতি সেন বলেন, ‘‘ওই বিচারপতির প্রতি আমার শ্রদ্ধা রয়েছে। আমার সকলের প্রতি শ্রদ্ধা রয়েছে।’’ এর পরেই উচ্চ প্রাথমিকের মামলা থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা জানান বিচারপতি সেন। তাঁর কথায়, ‘‘অনেকে আসবেন, অনেকে যাবেন। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠান রয়ে যাবে। তাই আমি এই পরিস্থিতি নিয়ে কিছু বলতে চাই না।’’
মামলা ছাড়লেন বিচারপতি
উচ্চ প্রাথমিকের মামলা থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন বিচারপতি সেন। তাঁর এবং উদয় কুমারের ডিভিশন বেঞ্চে উচ্চ প্রাথমিকের মামলা চলছিল। মঙ্গলবার যার শুনানি হওয়ার কথা ছিল। বিচারপতি সেন জানান, তিনি এই মামলাটি ছেড়ে দিচ্ছেন।
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের বিচার্য বদল
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের হাত থেকে প্রাথমিকের স্কুলে নিয়োগের মামলা সরিয়ে দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি শিবজ্ঞানম। এর আগে তাঁর কাছ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল এসএসসি সংক্রান্ত মামলা। মঙ্গলবার প্রাথমিকের মামলা সরে যাওয়ায় শিক্ষা সংক্রান্ত কোনও মামলাই আর বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে রইল না। প্রধান বিচারপতি স্বাক্ষরিত একটি নির্দেশিকায় জানানো হয়েছে, এখন থেকে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে থাকা প্রাথমিক মামলার শুনানি হবে বিচারপতি রাজাশেখর মান্থার বেঞ্চে। বদলে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় শুনবেন শ্রম এবং শিল্প আইন সংক্রান্ত মামলাগুলি। এ ছাড়া, শিক্ষা মামলায় গ্রেফতারি সংক্রান্ত কিছু মামলা থাকবে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে।
আদালতের সামনে বিক্ষোভ
মামলা নিয়ে এই টানাপড়েনের মাঝে মঙ্গলবার আদালতের সামনে বিক্ষোভ দেখান এক দল চাকরিপ্রার্থী। তাঁরা উচ্চ প্রাথমিকের চাকরিপ্রার্থী। তাঁদের দাবি, বিচারপতিদের সংঘাতের ফল তাঁদের ভুগতে হচ্ছে। তাঁদের মামলা এই কারণে আরও দীর্ঘায়িত হচ্ছে। হাই কোর্টের ‘বি গেট’ বা প্রধান ফটকের সামনে গিয়ে বিক্ষোভ দেখান তাঁরা। ওই ফটক দিয়ে আইনজীবীরা যাতায়াত করেন। কিছু ক্ষণ বিক্ষোভ চলার পর পুলিশ তাঁদের সরিয়ে দেয়।
‘আমরা বিচার চাই’
চাকরিপ্রার্থী সুশান্ত ঘোষ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘আমরা বিচার চাই। অন্যায় ভাবে আমরা চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়েছি। দীর্ঘ দিন ধরে আমাদের মামলা আদালতে বিচারাধীন। বিচারপতি সেনের এজলাসে এত দিন এই মামলা চলছিল। শুনানিও প্রায় শেষের দিকে ছিল। আর দু’চার দিনের মধ্যে শুনানি শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। এই অবস্থায় বিচারপতি সেন মামলা ছেড়ে দিলেন। ওঁদের সংঘাতের ফলে মামলাটি এখন আবার নতুন বেঞ্চে যাবে, প্রক্রিয়া আরও দীর্ঘায়িত হবে। আমরা সুবিচার চাই।’’