১৬ জুলাই অনাস্থা ভোটের দিন বনগাঁ পুরভবনের সামনে ধুন্ধুমার। —ফাইল চিত্র
বনগাঁ পুরসভার অনাস্থা ভোট নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের চূড়ান্ত ভর্ৎসনার মুখে রাজ্য সরকার এবং বনগাঁ পুরসভার চেয়ারম্যান। একের পর এক কড়া মন্তব্যে রাজ্য সরকার এবং চেয়ারম্যান শঙ্কর আঢ্যকে বিঁধেছেন বিচারপতি সমাপ্তি চট্টোপাধ্যায়। বনগাঁর চেয়ারম্যানের উদ্দেশে বিচারপতির মন্তব্য, ‘‘কাউন্সিলররা সঙ্গে নেই, তবু চেয়ার আঁকড়ে পড়ে রয়েছেন! এত নির্লজ্জ আপনি?’’ প্রাথমিক ভাবে ফের আস্থা ভোটের কথা বললেও এখনও চূড়ান্ত রায় দেননি বিচারপতি। স্বাভাবিক ভাবেই বনগাঁর অনাস্থা ভোট নিয়ে আদালতে রাজ্য সরকারের মুখ পুড়ল বলেই মত আইনজীবী মহলের।
বনগাঁ পুরসভায় অনাস্থার ভোটাভুটির কথা ছিল ১৬ জুলাই। কিন্তু সে দিন বিজেপির কাউন্সিলরদের ওই প্রক্রিয়ায় ঢুকতেই দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ। পরে তৃণমূল এবং বিজেপি উভয় পক্ষই দাবি করে পুরসভার ক্ষমতা তাঁদের দখলে। এ নিয়েই বিজেপি হাইকোর্টে মামলা দায়ের করে। সেই মামলার শুনানিতেই শুক্রবার বিচারপতি সমাপ্তি চট্টোপাধ্যায় রাজ্য সরকার এবং বনগাঁ পুরসভার চেয়ারম্যানকে তীব্র ভর্ৎসনা করেন বিচারপতি। বনগাঁ পুরসভার চেয়ারম্যান শঙ্কর আঢ্যের উদ্দেশে বিচারপতির মন্তব্য, ‘‘চেয়ার আঁকড়ে কেন পড়ে রয়েছেন? যখন সংখ্যাগরিষ্ঠতা আপনার সঙ্গে নেই, তখন আপনাকে ফল ভোগ করতেই হবে। কেন পদ আঁকড়ে আছেন, এটা গণতন্ত্র। এত নির্লজ্জ কেন আপনি?’’
বিজেপির অভিযোগ ছিল, পুলিশ দিয়ে তাদের দুই কাউন্সিলরকে আটকে দেওয়া হয়েছিল অনাস্থা ভোটের দিন। দুই কাউন্সিলরকে অনাস্থা কক্ষে দূরে থাক, পুরভবনেই ঢুকতে দেয়নি পুলিশ। অথচ হাইকোর্টের দেওয়া গ্রেফতারির উপর স্থগিতাদেশের নথি দেখিয়েছিলেন তাঁরা। এই প্রসঙ্গেই বিচারপতি বলেন, ‘‘বনগাঁ পুরসভার চেয়ারম্যান বিরাট প্রভাবশালী।’’
চূড়ান্ত রায় না দিলেও অনাস্থা ভোটের প্রক্রিয়া যে সুষ্ঠু ভাবে হয়নি, তা বিচারপতির মনোভাবেই স্পষ্ট হয়েছে এ দিন। এমনকি, ফের অনাস্থা ভোট হতে পারে বলেও প্রাথমিক ভাবে জানিয়ে দিয়েছেন বিচারপতি সমাপ্তি চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে, ফের অনাস্থা ভোট হওয়া দরকার।’’ পুলিশ সুপারের উপস্থিতিতে জেলাশাসক বা মহকুমা শাসকের দফতরে আস্থা ভোট নেওয়ার কথাও বলেছেন তিনি। আইনজীবীদের মত, এই ভাবে অনাস্থা ভোট হলে তার পরেও কোনও অশান্তি হলে বা অনাস্থার প্রক্রিয়ায় কোনও গলদ ধরা পড়লে জেলাশাসক, মহকুমা শাসক বা পুলিশ সুপারকে দায়ী করা যাবে। সেই কারণেই প্রাথমিক ভাবে এই দাওয়াই দিয়েছেন বিচারপতি।
আরও পডু়ন: সময়সীমা শেষ, তবু কর্নাটকে হল না আস্থা ভোট! তিনটে পর্যন্ত মুলতুবি বিধানসভা
গোটা অনাস্থার প্রক্রিয়ায় রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আদালত যে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ, তা কার্যত কথায় কথায় বুঝিয়ে দিয়েছেন বিচারপতি। এমনকি, রাজ্য সরকারের আইনজীবীরা এক্সিকিউটিভ অফিসারের সই করা অনাস্থার নথি দেখিয়েও পার পাননি। বিচারপতি প্রশ্ন তোলেন, এগ্জিকিউটিভ অফিসারের ওই নথি কি গীতা! তাঁকে যে জোর করে বা চাপ দিয়ে সই করানো হয়নি, তার কী প্রমাণ আছে? —এমন মন্তব্য করতেও শোনা যায় তাঁকে। পরে যদিও এই মন্তব্য পরিবর্তন করেন বিচারপতি।
চূড়ান্ত রায় না হলেও বিচারপতির এই মন্তব্যেই জয় দেখছে বিজেপি। এবং ফের অনাস্থা ভোট হলে যে তাদেরই জয় হবে, তা এক প্রকার নিশ্চিত পদ্ম শিবির। কারণ ১১ জন কাউন্সিলর বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। সংখ্যার বিচারে তাঁরাই এগিয়ে। অন্য দিকে তৃণমূলের পক্ষে রয়েছেন ৯ জন কাউন্সিলর। ১ জন করে কাউন্সিলর কংগ্রেস এবং সিপিএমের। সিপিএম আগেই জানিয়ে দিয়েছে, তারা আস্থা ভোটে অংশ নেবে না। ফলে অনাস্থায় উপস্থিত কাউন্সিলরের সংখ্যার নিরিখে ম্যাজিক ফিগার দাঁড়াবে ১১। বিজেপির হাতে সেই সংখ্যক কাউন্সিলরই রয়েছে।
আরও পডু়ন: ‘আকাশ থেকে পড়বে না ৫ লক্ষ কোটির অর্থনীতি’, নির্মলার দাবি নিয়ে তির্যক মন্তব্য প্রণবের
শুক্রবারের শুনানিতে বিচারপতি সমাপ্তি চট্টোপাধ্যায় বিজেপির উদ্দেশে বলেন, আপনাদের সুযোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু সরকার ভুল করলে তা সংশোধন করতে হবে আদালতকেই। না হলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই ভেঙে পড়বে।
তৃণমূল পরিচালিত ২২ আসনের বনগাঁ পুরসভায় ১৪ জন কাউন্সিলর বিজেপিতে যোগ দেন। যদিও পরে ৩ জন তৃণমূলে ফিরে যান। গত ১৬ জুলাই আস্থা ভোট হয় বনগাঁ পুরসভায়। কিন্তু দুই কাউন্সিলররের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা দায়ের হয়েছিল। তাঁরা হাইকোর্ট থেকে জামিনের নথি দেখালেও তাঁদের অনাস্থা পুরসভা ভবনেই ঢুকতে দেয়নি পুলিশ। বাকি ৯ কাউন্সিলরও অনাস্থা কক্ষে ঢোকেননি। ফলে তৃণমূল দাবি করে বিজেপির কোনও কাউন্সিলর অনাস্থায় যোগ না দেওয়ায় বনগাঁ পুরসভা তাঁদের দখলেই রয়েছে। আবার সাড়ে তিনটে নাগাদ অনাস্থা কক্ষে যান বিজেপি কাউন্সিলররাও। বাইরে বেরিয়ে তাঁরাও দাবি করেন, অনাস্থায় তাঁদের জয় হয়েছে এবং ক্ষমতা দখল করেছেন বনগাঁ পুরসভার।
(এই প্রতিবেদনটি প্রথম প্রকাশের সময় শেষের দিকে এক জায়গায় ‘কাউন্সিলর’-এর পরিবর্তে ‘বিধায়ক’ লেখা হয়েছিল। এই অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্য আমরা দুঃখিত।)