মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —গ্রাফিক সনৎ সিংহ।
প্রায় এক মাস হতে চলল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নবান্নে যাননি। স্পেন এবং দুবাই সফর থেকে ফিরেই তাঁর পায়ের আঘাতের চিকিৎসার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। গত ২৪ সেপ্টেম্বর এসএসকেএম হাসপাতালে পায়ের চিকিৎসার পরে বাড়ি থেকেই রাজ্য প্রশাসনের যাবতীয় কাজের তদারকি করছেন মুখ্যমন্ত্রী। বৃহস্পতিবার কালীঘাটের বাড়িতে রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠক ডেকেছেন মমতা। নিজের বাড়িতে রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠক ডাকার নজির কি বাংলায় রয়েছে?
প্রসঙ্গত, মমতার কালীঘাটের বাড়ি মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি আবাস নয়। সেটি তাঁর ব্যক্তিগত আবাসস্থল। আজীবন তিনি সেখানেই থাকেন। টালির চালের সেই বাড়িতেই প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন এসেছিলেন অধুনাপ্রয়াত অটলবিহারী বাজপেয়ী। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরেও তিনি সেই ঠিকানা ছাড়েননি। যেমন মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন পাম অ্যাভিনিউয়ের ফ্ল্যাট ছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ব্যক্তিগত আবাস। ১৯৮০ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত সেখানেই থাকেন বুদ্ধদেব। সল্টলেকের ইন্দিরা ভবনেও প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর আবাস ছিল মাত্র। কিন্তু সেটি ‘মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন’ নয়। যেমন ৩০ বি, হরিশ চ্যাটার্জি রোডের বাড়িটিও ‘মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন’ নয়। বস্তুত, পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর জন্য নির্দিষ্ট কোনও সরকারি বাসভবন (যেমন নয়াদিল্লির ৭, রেসকোর্স রোডে দেশের প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন) নেই। বুদ্ধদেব এবং মমতা— উভয়কেই নিরাপত্তার কারণে তাঁদের বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র থাকার অনুরোধ করলেও তাঁরা তা মানতে চাননি। দু’জনেরই বক্তব্য ছিল, তাঁরা এই বাড়িতে থেকেই স্বচ্ছন্দ।
বুদ্ধদেব আগে অন্যত্র থাকলেও মমতার আশৈশব ঠিকানা এই বাড়িটিই। এই বাড়ি থেকেই তাঁর রাজনীতি শুরু। ১৯৮৪ সালে যাদবপুর কেন্দ্র থেকে অধুনাপ্রয়াত সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে হারিয়ে সাংসদ হওয়া। তার পরে তিনি যখন দক্ষিণ কলকাতার সাংসদ, তখনও তাঁর ঠিকানা এই বাড়িই। বিরোধী পক্ষেই থাকুন বা সরকার পক্ষে— কালীঘাটের বাড়িই মমতার একমাত্র ঠিকানা হয়ে রয়ে গিয়েছে। এই বাড়িতে মমতার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন বাঘা বাঘা নেতা। এসেছেন লোকসভার প্রাক্তন স্পিকারেরা। দেশের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের প্রাক্তন বা শাসক মুখ্যমন্ত্রীরাও। এসেছেন ভারত-বিখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও। মমতার রাজনৈতিক জীবনের সমস্ত উত্থানপতনের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে এই বাড়ি। সেখানেই মন্ত্রিসভার সদস্যদের বৈঠকে ডেকেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা।
তবে বুদ্ধদেব কখনও নিজের পাম অ্যাভিনিউয়ের ফ্ল্যাটে রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠক ডাকেননি। যেমন নিজের বাসভবনে কখনও রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠক ডাকেননি প্রয়াত বসুও। মমতাও এই প্রথম তাঁর বাড়িতে রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠক ডেকেছেন। এর আগে তিনি বিধানসভা ভবনে রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠক করেছেন। কিন্তু নিজের বাড়িতে এই প্রথম।
রাজ্যের প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রসচিব অর্ধেন্দু সেন জানান, মুখ্যমন্ত্রী অবশ্যই তাঁর ব্যক্তিগত বাসভবনে রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠক ডাকতে পারেন। অর্ধেন্দু বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে ক্যাবিনেট বৈঠক বাংলায় কবে হয়েছে মনে করতে পারছি না। তবে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের আমলে অনেক বার রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠক হয়েছে বিভিন্ন জেলায়। সেই সব ঘটনা মনে আছে। কিন্তু সিদ্ধার্থবাবুর বাড়িতে কখনও ক্যাবিনেট মিটিং হয়েছে বলে শুনিনি।’’ মুখ্যমন্ত্রী কি তাঁর বাড়িতে মন্ত্রিসভার বৈঠক ডাকতে পারেন? অর্ধেন্দুর জবাব, ‘‘ডাকতেই পারেন।’’
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রাক্তন অতিরিক্ত মুখ্যসচিব প্রসাদরঞ্জন রায়ের বক্তব্য, ‘‘আমি মনে করতে পারছি না, কবে এই রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনে রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠক হয়েছে। তবে আমি মনে করতে পারছি না মানে তা হয়নি, তা-ও নয়।’’ প্রসাদরঞ্জনের কথায়, ‘‘১৯৮০ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত, যত দিন আমি কর্মরত ছিলাম, তত দিন দেখিনি।’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘তবে অন্য রাজ্যে এমন রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠক মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনে হয় বলে শুনেছি।’’
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিদ্যা ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন প্রধান প্রশান্ত রায় বলেন, ‘‘আমার যত দূর স্মরণে রয়েছে, তাতে মনে পড়ছে না, বাংলার কোনও মুখ্যমন্ত্রী তাঁর বাড়িতে মন্ত্রিসভার বৈঠক করেছেন। জ্যোতিবাবুর পেটের সমস্যা ছিল। যা পরে তাঁর মূল অসুখ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেই কারণে অনেক ক্ষেত্রে মন্ত্রিসভার বৈঠকের সময়ের রদবদল হয়েছে। কিন্তু বাড়িতে কখনও মন্ত্রিসভার বৈঠক ডাকতে শুনিনি। তার আগেও এ রকম হয়েছে বলে জানা নেই।’’ তবে পাশাপাশিই তাঁর কথায়, ‘‘সংবিধানে এমন কিছু বলা নেই যে, মুখ্যমন্ত্রী তাঁর বাড়িতে মন্ত্রিসভার বৈঠক ডাকতে পারবেন না বা পারেন না।’’
কোভিডের সময়ে অনেক সময়েই ভার্চুয়াল মাধ্যমে রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠক হয়েছে। অনেক রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনেও মন্ত্রিসভার বৈঠক হয়েছে। তবে বাংলায় স্মরণকালে তা হয়নি বলেই জানাচ্ছেন রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত এবং রাজনীতির ইতিহাস সম্পর্কে ওয়াকিবহাল অনেকে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারে আসার পর প্রথম দু’বছর মহাকরণই ছিল রাজ্য প্রশাসনের প্রধান সচিবালয়। ২০১৩ সালে তা স্থানান্তরিত হয়ে যায় গঙ্গার অপর পারের বহুতল নবান্নে। তবে নবান্নের বাইরে রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠক হওয়ার নজির রয়েছে। শেষ বাজেট অধিবেশনের সময়েই বিধানসভা ভবনে মন্ত্রিসভার বৈঠক ডেকেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। আবার ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তৎকালীন কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারের লাউডন স্ট্রিটের বাংলোয় সিবিআই হানার প্রতিবাদে মেট্রো চ্যানেলে ধর্নায় বসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। টানা কয়েক দিন সেই ধর্না চলেছিল। তার মধ্যেই এক দিন রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠক করেছিলেন মেট্রো চ্যানেল লাগোয়া কলকাতা পুলিশের আউট পোস্টে। তবে কালীঘাটের বাড়িতে রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠক এই প্রথম।
মমতার কালীঘাটের বাড়িটি আরও একটি ইতিহাসে ঢুকে পড়ল। বৃহস্পতিবার।