তৃণমূলের ভয়ে কিছুই দেখছেন না শিল্পকর্তারা

‘মাস্টারমশাই, আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি!’ রাজ্যের শিল্প ক্ষেত্রে একের পর এক হিংসাত্মক ঘটনার প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তপন সিংহের ‘আতঙ্ক’ ছবির এই সংলাপকেই মনে করাচ্ছেন বণিকসভার কর্তারা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:৩৫
Share:

‘মাস্টারমশাই, আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি!’

Advertisement

রাজ্যের শিল্প ক্ষেত্রে একের পর এক হিংসাত্মক ঘটনার প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তপন সিংহের ‘আতঙ্ক’ ছবির এই সংলাপকেই মনে করাচ্ছেন বণিকসভার কর্তারা।

বুধবার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বার্ন স্ট্যান্ডার্ডের আধিকারিকদের উপর হামলার ঘটনার নিন্দা করেছেন শিল্পমহলের কর্তারা। কিন্তু এই বিষয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে নারাজ তাঁরা। তাঁদের আতঙ্ক, মুখ খুললেই হয়তো তৃণমূলের ‘টার্গেট’ হয়ে যেতে হবে। তাই সব দেখেও মুখে কুলুপ শিল্পমহলের।

Advertisement

অতীতের রেশ টেনে শ্রমিক আন্দোলনের নামে এ দিন বার্ন স্ট্যান্ডার্ডের কর্তাদের হেনস্থার অভিযোগ উঠেছে খোদ হাওড়া পুরসভার চেয়ারম্যান ও মেয়র পারিষদদের একাংশ তথা শাসক দলের নেতাদের বিরুদ্ধে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, সরকারি ক্ষেত্রেই যদি এই ঘটনা ঘটে, তা হলে শিল্পায়নের মানচিত্রে রাজ্য কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? বিশেষ করে যখন রাজ্যে সাম্প্রতিক কালে বড় শিল্পের নজির নেই!

জবাবে সাবধানী রাজ্যের শিল্পকর্তারা। কিছু দিন আগেও হাতেগোনা দু’-এক জন প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। কিন্তু পরিস্থিতি এখন কতটা খারাপ হয়ে উঠেছে, তার প্রমাণ বার্ন স্ট্যান্ডার্ডের ঘটনায় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিল্পকর্তাদের অনেকেরই বক্তব্য। অনেকেই সব কিছু না জেনে প্রতিক্রিয়া জানাবেন না বলে এড়িয়ে গিয়েছেন। দু’-এক জন যা-ও বা বলেছেন, শর্ত রেখেছেন কোনও ভাবেই নাম প্রকাশ করা যাবে না।

তাঁদের বক্তব্য, এ ধরনের ঘটনা নিন্দনীয়। বারবার এই ঘটনা ঘটলে রাজ্যে বিনিয়োগ সম্পর্কে ভুল বার্তা যাবে। বিশেষ করে যখন রাজ্যে জমি বা অন্য পরিকাঠামোর অভাবের মতো জ্বলন্ত সমস্যা রয়েছে। কিন্তু পর ক্ষণেই তাঁরা বলছেন, ‘‘খোলাখুলি বলছি, এ সব নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলতে পারব না। এখানে কিছু বলা যায় না। তাতে রাজ্য সরকার ক্ষুব্ধ হবে। তা হলে চুপ থাকাই ভাল।” বণিকসভার আর এক কর্তার কথায়, “এ রকমটা যে একেবারেই হওয়া উচিত নয় তা শুধু আমি কেন, আমজনতাও তো জানেন।”

সমালোচনাকে যে রাজ্য সরকার ভাল ভাবে নেয় না, তা আমজনতা বিলক্ষণ জানেন। এর আগে বহু অভিযোগই ‘ছোট্ট ঘটনা’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই প্রসঙ্গে শিল্পমহল মনে করিয়ে দিচ্ছে, গত বছর বণিকসভা ফিকি-র সভার একটি ঘটনার কথা। অধুনা দিল্লিবাসী ফিকি-র অন্যতম সদস্য কে এস মেটা সভায় রাজ্যে কারখানায় হিংসাত্মক ঘটনায় ১৫ দিনের মধ্যে দু’জনের মৃত্যুর উল্লেখ করে আর্জি জানিয়েছিলেন, সরকারের তরফে একটা বার্তা দেওয়ার। আশ্বাস দূরের কথা, মুখ্যমন্ত্রী কার্যত সেই সব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে দাবি করেছিলেন, এমন কোনও তথ্য তাঁদের কাছে নেই। এবং স্বভাবসিদ্ধ ভাবে সংবাদমাধ্যমকে দুষে অভিযোগ করেছিলেন তারা সঠিক তথ্য দেয় না। শুধু তাই নয়, স্থানীয় শিল্পকর্তাদের দিয়ে বলিয়ে নিয়েছিলেন, এ রাজ্যে শিল্প সহায়ক পরিস্থিতি রয়েছে। এ দিন সেই ঘটনার উল্লেখ করে এক শিল্পকর্তার মন্তব্য, “সকলেই জানে এখানে এমন ঘটনা ঘটছে। কারা সে সবের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু অভিযোগ জানিয়েও কোনও প্রতিকার মেলে না।” তাঁর প্রশ্ন, “খোদ মুখ্যমন্ত্রী যখন সেই সব অভিযোগ মানতে নারাজ, তখন কে-ই বা মঞ্চে তাঁর উপস্থিতিতে সে কথা বলার সাহস দেখাবেন?”

কিন্তু রাজ্যে এমন জঙ্গি আন্দোলন তো নতুন নয়? তা মেনে নিয়েও শিল্পকর্তাদের প্রশ্ন, এখনও তা চললে রাজ্যে লগ্নি আসবে কেন? শিল্পমহলের আরও প্রশ্ন, কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও হিংসাত্মক আন্দোলনকে কি প্রশ্রয় দেওয়া উচিত? সে জন্য কারও কি প্রাণ যাওয়া উচিত? এর সঙ্গে তাঁরা জুড়ছেন, তৃণমূলের আমলে নেতাদের লাগামছাড়া দাপটের উদাহরণ। অনেকেরই বক্তব্য, বহু এলাকায় শাসক দলের একাধিক নেতা ইউনিয়নের রাশ তাঁর হাতে থাকার দাবি করছেন। তাঁদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের মাসুল দিতে হচ্ছে শিল্পকে।

কিন্তু শাসক দলের দাদাগিরির ভয়ে এ সব প্রকাশ্যে বলতে চাইছেন না শিল্পকর্তারা। বার্ন স্ট্যান্ডার্ডের ঘটনার প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়েও সাবধানী শিল্পকর্তাদের মুখে তাই বাংলা চলচিত্রের সেই বিখ্যাত সংলাপ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement