অনুদান এলেও থেকেই গেল ধারের বোঝা

আগামীর সুরাহা হয়তো কিছুটা হল। কিন্তু পিছু ছাড়ল না পুরনো সমস্যা। রাজস্ব ঘাটতির ভূত ঘাড় থেকে নামাতে অনুদানের প্রতিশ্রুতি মিলল। কিন্তু থেকেই গেল বিপুল ঋণের বোঝা। দু’লক্ষ কোটি টাকার বেশি ধার শোধের সমস্যা থেকে রাজ্যকে মুক্তি ‘দিতে পারল না’ চতুর্দশ অর্থ কমিশনও। যার সুপারিশের দিকে বহু দিন কার্যত হাপিত্যেশ করে তাকিয়েছিল রাজ্য সরকার। মঙ্গলবার কেন্দ্র জানিয়েছে, চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সুপারিশ মেনে পশ্চিমবঙ্গকে ১১ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা অনুদান দেবে মোদী-সরকার। অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির দাবি, রাজস্ব ঘাটতি মেটাতে আগামী দু’বছরে এই অনুদান দেওয়া হবে। তার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের রাজস্ব ঘাটতি থাকবে না। উল্টে রাজস্ব উদ্বৃত্ত হবে বলে মনে করছে কমিশন। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি জানান, “পশ্চিমবঙ্গের পুরনো ঋণের যে সমস্যা ছিল, তা থাকবে।”

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নয়াদিল্লি ও কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:৪৯
Share:

আগামীর সুরাহা হয়তো কিছুটা হল। কিন্তু পিছু ছাড়ল না পুরনো সমস্যা। রাজস্ব ঘাটতির ভূত ঘাড় থেকে নামাতে অনুদানের প্রতিশ্রুতি মিলল। কিন্তু থেকেই গেল বিপুল ঋণের বোঝা। দু’লক্ষ কোটি টাকার বেশি ধার শোধের সমস্যা থেকে রাজ্যকে মুক্তি ‘দিতে পারল না’ চতুর্দশ অর্থ কমিশনও। যার সুপারিশের দিকে বহু দিন কার্যত হাপিত্যেশ করে তাকিয়েছিল রাজ্য সরকার।

Advertisement

মঙ্গলবার কেন্দ্র জানিয়েছে, চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সুপারিশ মেনে পশ্চিমবঙ্গকে ১১ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা অনুদান দেবে মোদী-সরকার। অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির দাবি, রাজস্ব ঘাটতি মেটাতে আগামী দু’বছরে এই অনুদান দেওয়া হবে। তার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের রাজস্ব ঘাটতি থাকবে না। উল্টে রাজস্ব উদ্বৃত্ত হবে বলে মনে করছে কমিশন। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি জানান, “পশ্চিমবঙ্গের পুরনো ঋণের যে সমস্যা ছিল, তা থাকবে।”

কমিশনের সুপারিশ এবং মোদী-সরকারের এই ঘোষণায় প্রত্যাশিত ভাবেই খুশি নয় রাজ্য সরকার তথা তৃণমূল নেতৃত্ব। এ নিয়ে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে ফের বঞ্চনার অভিযোগই তুলেছে তারা। তৃণমূলের জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েন বলেন, “পশ্চিমবঙ্গের ঋণ মকুব, মোরাটোরিয়াম (ঋণ ও সুদ শোধের উপর স্থগিতাদেশ) নিয়ে কোনও শব্দই নেই।” কিন্তু তা উড়িয়ে দিয়ে জেটলির যুক্তি, অর্থ কমিশনের সুপারিশ মেনেই রাজস্ব ঘাটতি মেটাতে পশ্চিমবঙ্গ-সহ ১১টি রাজ্যকে অনুদান দেওয়ার সিদ্ধান্ত। এর সঙ্গে রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই।

Advertisement

কেন্দ্রের ব্যাখ্যা, অনুদান পাওয়া ১১টি রাজ্যের মধ্যে যেমন পশ্চিমবঙ্গ, কেরল, হিমাচলপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ রয়েছে, তেমনই আছে ত্রিপুরা-সহ উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলি। অথচ সেখানে পঞ্জাবের নাম নেই। পঞ্জাবে এনডিএ-শরিক শিরোমণি অকালি দল ও বিজেপির সরকার রয়েছে। ওই রাজ্যের মাথাতেও রয়েছে পুরনো ঋণের বোঝা। তা-ও রাজস্ব ঘাটতি না-থাকায়, তারা অনুদান পায়নি।

কেন্দ্রীয় অনুদানের ১১,৭৬০ কোটি টাকার মধ্যে ২০১৫-’১৬ সালে প্রথম কিস্তিতে ৮,৪৪৯ কোটি পাবে নবান্ন। পরের অর্থবর্ষে মিলবে ৩,৩১১ কোটি টাকা। আর এর ফলে তার পরের বছরই পশ্চিমবঙ্গের হাতে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি রাজস্ব উদ্বৃত্ত থাকবে বলে অর্থ কমিশনের হিসেব। তাদের দাবি, ২০১৯-’২০ সালে উদ্বৃত্তের পরিমাণ ধাপে ধাপে বেড়ে পৌঁছবে ১৮,১১৯ কোটি টাকায়।

কিন্তু এই হিসেব পেয়েও খুশি হতে পারেনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। কারণ, মুখ্যমন্ত্রীর মসনদে বসার পর থেকেই রাজ্যের মাথায় ২ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি ঋণের বোঝা চেপে থাকা নিয়ে বারবার অভিযোগ জানিয়ে এসেছেন মমতা। প্রায় প্রতি জনসভায় নিয়ম করে বলেছেন, কেন্দ্র সুদ-আসল বাবদ প্রতি বছর প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা কেটে নিয়ে চলে যাচ্ছে বলে উন্নয়নের কাজে পুরোদমে হাত দিতে পারছে না তাঁর সরকার। প্রশ্ন তুলেছেন, বাম জমানার ওই বিপুল ঋণের বোঝা তাঁর সরকার বইবে কেন? বিশেষত যেখানে রাজ্যের আয়ের বেশিরভাগটাই চলে যাচ্ছে ওই ঋণ ও তার সুদ মেটাতে।

ধার শুধতে গিয়ে উন্নয়নের জন্য টাকায় টান পড়ার অভিযোগ তুলে সেই ইউপিএ-জমানা থেকেই কেন্দ্রীয় ঋণ মকুব, তিন বছরের জন্য ঋণ ও সুদ শোধের উপর স্থগিতাদেশ, স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্প থেকে নেওয়া ঋণ শোধ করতে বিশেষ অর্থসাহায্য ইত্যাদি দাবি জানিয়ে আসছেন মমতা। তাতে কাজের কাজ কিছু হয়নি। প্রণব মুখোপাধ্যায় অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন রাজ্যের অনগ্রসর এলাকা উন্নয়ন খাতে সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিলেন (সেই টাকার অর্ধেকও খরচ করতে পারেনি রাজ্য)। এটুকু ছাড়া প্রণব থেকে চিদম্বরম হয়ে জেটলি কেউই পশ্চিমবঙ্গের ঋণ সমস্যা মেটানোর রাস্তা খুঁজে পাননি।

এরই মধ্যে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর ওয়াই ভি রেড্ডির নেতৃত্বে চতুর্দশ অর্থ কমিশন তৈরি হয়। তখন কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে অর্থ বণ্টনের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ, কেরল ও পঞ্জাবের ঋণ সমস্যা সমাধানের রাস্তা খোঁজারও দায়িত্ব দেওয়া হয় রেড্ডিকে। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই এই কমিশনের সুপারিশের দিকে আগ্রহভরে তাকিয়েছিল রাজ্য। কিন্তু সেখানেও শেষমেশ জুটল হতাশাই। তবে কমিশন জানিয়েছে, আগামী পাঁচ বছরে উন্নয়নের জন্য প্রায় ২০,৯০০ কোটি টাকা পাবে এ রাজ্যের পঞ্চায়েত ও পুরসভাগুলি। পুরো বিষয়টি নিয়ে প্রতিক্রিয়া চেয়ে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রকে টেলিফোন করা হলে, তিনি ফোন ধরেননি। জবাব দেননি এসএমএসেরও।

সার্বিক ভাবে কেন্দ্রীয় করের টাকা রাজ্যগুলির মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার যে সূত্র চতুর্দশ অর্থ কমিশন দিয়েছে, তাতেও খুশি নয় তৃণমূল। এত দিন কেন্দ্রীয় কর বাবদ আয়ের ৩২ শতাংশ রাজ্যগুলির মধ্যে ভাগ করে দিত দিল্লি (রাজ্যের দাবি ছিল ৫০%)। কমিশনের সুপারিশ মেনে এ বার থেকে দেওয়া হবে ৪২ শতাংশ। টাকার অঙ্কে তা কত দাঁড়াবে, সেটি স্পষ্ট হবে বাজেটে কেন্দ্রের কর আদায়ের অঙ্ক জানার পরে। কিন্তু কেন্দ্রীয় করের ভাগ বেশি পাওয়া নিয়েও ডেরেক বলেন, “আশা করেছিলাম, কেন্দ্রীয় করের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ রাজ্যকে দেওয়া হবে। দিচ্ছে মাত্র ৪২ শতাংশ। মোদী-সরকার মুখেই কেন্দ্র-রাজ্য সহযোগিতার কথা বলছে।”

রাজ্যের অর্থনীতির বেহাল দশার কথা তুলে ধরে রেড্ডির কমিশনের কাছে মমতার দাবি ছিল, বাম জমানার ২ লক্ষ কোটি টাকার বেশি ঋণের মধ্যে কেন্দ্রীয় ধার মকুব করা হোক। তিন বছর ছাড় দেওয়া হোক সুদ মেটানোয়। স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পে ধার শোধ করতে মঞ্জুর করা হোক বিশেষ অর্থসাহায্য। এর সঙ্গে দাবি ছিল, রাজ্যের আর্থ-সামাজিক ও পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য ২ লক্ষ ৫৫ হাজার কোটি টাকা অনুদানের।

কিন্তু কেন্দ্র কমিশনকে জানায় যে, কোনও রাজ্যেরই কেন্দ্রীয় ঋণ মকুব করা অসম্ভব। স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্প থেকে ঋণ মকুব করার বিপক্ষেও যুক্তি দিয়েছিল অর্থ মন্ত্রক। বলা হয়, সেই কাঠামোয় কোনও পরিবর্তন করা মানে দেশের লক্ষ লক্ষ আমানতকারীকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দেওয়া। এই সব কিছুর ভিত্তিতেই কমিশন বলেছে, “রাজ্যের মোট ধারের মধ্যে কেন্দ্রীয় ঋণের পরিমাণ খুবই সামান্য। তাই ঋণ পুনর্গঠনের জায়গাও সীমিত। তা ছাড়া, ঋণগ্রস্ত রাজ্যগুলিকে সুরাহা দেওয়ার অর্থ যে সব রাজ্যে আর্থিক শৃঙ্খলা আছে, তাদের শাস্তি দেওয়া।” বরং তার জায়গায় রাজস্ব ঘাটতি মিটিয়ে সেই টাকা পরিকাঠামোর মতো ক্ষেত্রে লগ্নির রাস্তা খুলে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে।

রাজনৈতিক ভাবেও এ দিন ঋণ মকুব না-করা নিয়ে তৃণমূলের অভিযোগের জবাব দিয়েছে বিজেপি। তাঁদের যুক্তি, তৃণমূল ক্ষমতায় আছে বলে পশ্চিমবঙ্গকে বঞ্চনা করা হয়নি। বাড়তি সুবিধা পায়নি বিজেপি-শাসিত কোনও রাজ্য। শুধু পশ্চিমবঙ্গকে ঋণ মকুবের সুবিধা দেওয়া হলে, বঞ্চনার অভিযোগ তুলত অন্য রাজ্যগুলি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement