ইস্কোর আধুনিকীকরণ প্রকল্প ঘোষণার পরে জমি অধিগ্রহণ এবং উচ্ছেদের প্রতিবাদে বার্নপুরে ধর্নায় বসেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। — ফাইল চিত্র।
মহাকরণে নিজের দফতরে ছিলেন সে দিন। দিল্লি থেকে একটা ফোন এসেছিল। ‘মিঃ ভট্টাচার্যি, রামবিলাসকে বেসরকারি হাত কিনতে পারে না! বলেছিলাম আপনাকে!’ ফোন ধরে চমকে গিয়েছিলেন প্রথমটায়! পরে বুঝেছিলেন কেন্দ্রীয় ইস্পাতমন্ত্রী আসলে খবর দিচ্ছেন, ইস্কোর আধুনিকীকরণের প্রকল্প পাকা হয়ে গিয়েছে। সেল-ই কাজটা করবে। প্রকল্পের শিলান্যাস করবেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ।
এ বার তাঁকে কেউ ফোন করেনি। কালের স্রোতে প্রধানমন্ত্রী বদলে গিয়েছেন। নতুন প্রধানমন্ত্রী বার্নপুরে দাঁড়িয়ে ইস্কোর নতুন কারখানা জাতির উদ্দেশে উৎসর্গ করেছেন। পাশে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী। যিনি হাসিমুখে এই প্রকল্পের কৃতিত্ব দাবি করে বসেছেন! প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীর নাম কেউ কোথাও করেননি। ঘটনাস্থল থেকে দূরে বসে টিভিতে এত সব কর্মকাণ্ড দেখে একই সঙ্গে স্বস্তি এবং বিস্ময় ছুঁয়ে গিয়েছে তাঁকে। প্রকল্পটা সম্পূর্ণ হয়েছে, এর জন্য তৃপ্তিও আছে অবশ্যই।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে এ বার কেউ আনুষ্ঠানিক ভাবে ধন্যবাদ জানায়নি। অনুষ্ঠানে তাঁকে আমন্ত্রণ করার প্রশ্নই নেই। তবু সে দিনের মুখ্যমন্ত্রী আজ প্রাক্তন হয়ে গিয়েও স্বস্তিতে! কেন? বাংলার রাজনীতির ইতিহাসে বাম জমানার এই কাণ্ডারীর নাম জমি-যুদ্ধে ব্যর্থতার সঙ্গেই জড়িয়ে গিয়েছে। শিল্পের নামে জমি নিতে গিয়ে সরকার এবং দলের পায়ের তলার জমি হারিয়ে গিয়েছে, এমন মূল্যায়নই নির্দিষ্ট হয়েছে তাঁর জন্য। বুদ্ধবাবু নিজে অবশ্য বরাবর মনে করে এসেছেন, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম ব্যতিক্রম। আরও অনেক প্রকল্পের জন্য হাজার হাজার একর জমি নেওয়া হয়েছে সমস্যা কাটিয়ে। তবু সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের স্মৃতিই বারবার সামনে আনা হয়! ইস্কোর আধুনিক কারখানার সূচনার দিন অন্তত জনসমক্ষে এটাও সূচিত হল যে, বুদ্ধবাবুর জমানা মানেই শুধুই ব্যর্থতার ইতিহাস নয়!
আর বিস্ময় কেন? কারণ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিদায় নেওয়ার পরেই আসানসোলে দাঁড়িয়ে বুদ্ধবাবুর উত্তরসূরি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেছেন, ‘‘আমরা যদি তিন হাজার একর জমি না দিতাম, ইস্কোর আধুনিকীকরণ বা সম্প্রসারণ কিছুই সম্ভব হতো না! এই কারখানা খুলে গিয়ে পূর্বাঞ্চলের জন্য নতুন দিগন্ত খুলে গেল।’’ শুনে স্মিত হাসছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। বলছেন, ‘‘কী আর বলব! এই রকম তো হয়েই আসছে!’’ স্মৃতি এখনও টাটকা বুদ্ধবাবুর, ‘‘কত লড়তে হয়েছিল তখন। কত রকম চাপ। শেষ পর্যন্ত আমরা মনমোহন সিংহের সরকারকে বোঝাতে পেরেছিলাম, সেলের হাতে রেখেই ইস্কোর পুনরুজ্জীবন সম্ভব।’’
বণিক মহলের একাংশ অবশ্য বলছে, রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর কৃতিত্ব দাবি বা প্রাক্তনের তৃপ্তি— কোনওটারই বিশেষ মূল্য নেই অর্থনীতির জগতে। কারণ ওই অংশের মতে, ইস্কোর এই আধুনিকীকরণের প্রকল্পে ১৬ হাজার কোটি টাকা খরচ করা আসলে সাদা হাতি পোষারই নামান্তর! বিদেশে ইস্পাত শিল্পের বাজার যখন বেশির ভাগই চিনের দখলে, তখন আধুনিকীকরণের নামে চড়া দামে ইস্পাত তৈরি করে তা কোথায় বিক্রি করবে ইস্কো? বণিক মহলের একাংশের মতে, ইস্কোর আধুনিকীকরণের এই প্রয়াস বাণিজ্যিকের চেয়ে আরও অনেক বেশি করে রাজনৈতিক।
বুদ্ধবাবুদের স্বস্তিও সেই রাজনৈতিক কারণেই। মতাদর্শগত দিক থেকে তাঁরা বরাবরই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বাঁচিয়ে রাখার পক্ষে। এ রাজ্যে ইস্কোর মতো ধুঁকতে থাকা একটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার পুনরুজ্জীবনের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে সম্মতি ও সাহায্য আদায় এবং সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের বদনাম মাথায় নিয়েও তার জন্য জমির বন্দোবস্ত করা— তৎকালীন বাম সরকারের পক্ষে রাজনৈতিক স্বস্তির কারণ বৈকি! সে কারখানার বাজার নিয়ে যতই সংশয় থাক না কেন! বস্তুত, ভিন্ন কারণে সংশয় সিপিএম তথা বামফ্রন্টের অন্দরেও ছিল। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের পরে আবার জমির ব্যবস্থা করতে গিয়ে যদি গোলমাল হয়! বুদ্ধ-নিরুপম সেন জুটি তখন পিছোতে চাননি।
সেই সময় কী ছিল বিরোধী নেত্রী মমতার ভূমিকা? ‘পশ্চিমবঙ্গ কৃষিজমি রক্ষা কমিটি’র হয়ে ধর্না দিতে গিয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী। সঙ্গে মলয় ঘটক, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সমীর পূততুণ্ডেরা। এখন তা হলে কৃতিত্ব দাবি কেন? রাজ্যের এক মন্ত্রীর বক্তব্য, ‘‘অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকারের কাছে ১৯৯৮ সালে আমাদের নেত্রী ‘বেঙ্গল প্যাকেজে’র দাবি করেছিলেন। তার মধ্যেই ইস্কো বাঁচানোর দাবি ছিল।’’ আর সমীরবাবু বলছেন, ‘‘আমরা কিন্তু প্রকল্পে বাধা দিতে যাইনি। জমির জন্য যাঁদের উচ্ছেদ করা হচ্ছিল, তাঁদের আরও ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিলাম। শেষ পর্যন্ত তাঁরা বেশি দামও পেয়েছেন, প্রকল্পটাও হয়েছে।’’
বুদ্ধবাবুর অবশ্য মনে আছে, ‘‘কত কাণ্ড ঘটছিল তখন!’’ তবু তার মধ্যেও আধুনিক ইস্কো দিনের আলো দেখেছে। পর্দা উন্মোচন করে হাততালির ভাগ মোদী-মমতা জুটি নিয়ে গেলেও এক টুকরো স্বস্তি পাওনা হল আলিমুদ্দিনে স্থিত এক প্রাক্তনের!