রাজ্য সম্মেলনে বুদ্ধ। বৃহস্পতিবার।—নিজস্ব চিত্র।
দ্বিধাহীন কণ্ঠে ভুল মেনে নিলেন। আবার নিজের পথে অনড়ও থাকলেন। দু’টোই একই রকম প্রত্যয়ে!
সিপিএমের রাজ্য সম্মেলনের মঞ্চ থেকে সিঙ্গুর এবং নন্দীগ্রামের ব্যর্থতার জন্য খোলাখুলি দায় স্বীকার করে নিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। এই বিষয়ে ভুল স্বীকার তিনি আগেও করেছেন। কিন্তু এ বার সরাসরি একেবারে নিজের কাঁধেই যাবতীয় ভুলের দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন বুদ্ধবাবু। একই সঙ্গে তোপ দেগেছেন তাঁদের জমানায় শিক্ষায় ‘অনিলায়নে’র বিরুদ্ধে। সরাসরি বলেছেন, বাম আমলে শিক্ষা ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ‘সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়’ ছিল। সিপিএমের প্রয়াত প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাসের আমলে শিক্ষা ক্ষেত্রে দলীয় নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার নীতিরই কঠোর সমালোচনা বৃহস্পতিবার শোনা গিয়েছে বুদ্ধবাবুর গলায়।
মানুষের কাছে মাথা নিচু করে ওই ভুলের কথা কবুল করতে যাওয়ার পাশাপাশিই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর দৃঢ় ঘোষণা, শিল্পের জন্য জমি নেওয়া হবে না এমন কোনও অবস্থান কখনও মেনে নেওয়া যায় না। রাজ্যের লক্ষ লক্ষ চাকরিপ্রার্থী ছেলেমেয়ের স্বার্থে শিল্পের পথে এগোনো এবং তার জন্য প্রয়োজনে জমি নেওয়ার কোনও বিকল্প নেই। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের ব্যর্থতার পরেও এই বাস্তবের কথা বলতে তাঁর কোনও দ্বিধা নেই বলে দলীয় মঞ্চে সাফ জানান বুদ্ধবাবু।
‘বামফ্রন্ট সরকার: একটি পর্যালোচনা’ শীর্ষক একটি বিশেষ দলিল এ বার আলোচনার জন্য পেশ হয়েছিল সিপিএমের রাজ্য সম্মেলনে। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ওই দলিল লিখেছিলেন স্বয়ং বুদ্ধবাবুই। দলের রাজ্য কমিটিতে আগে আলোচনার পরে বৃহস্পতিবার দিনভর রাজ্য সম্মেলনে তা নিয়েই বিতর্ক চলেছে। পরে রাতে জবাবি ভাষণ দিতে গিয়ে বাম সরকারের সাফল্য এবং ব্যর্থতা নিয়ে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছেন বুদ্ধবাবু। তার মধ্যে ‘অনিলায়ন’ সম্পর্কে তাঁর খোলাখুলি আত্মসমালোচনাকেই সব চেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছে দলের একটি বড় অংশ।
সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের কথায়, “তৃণমূল এসে শিক্ষা জগতের কী হাল করেছে, দেখাই যাচ্ছে। কিন্তু আমরা যখন এই নিয়ে সমালোচনা করতে যাচ্ছি, মানুষ প্রশ্ন তুলছেন আপনারাই বা কী করেছিলেন? বুদ্ধদা আজ স্পষ্ট বলে দিলেন, মানুষের কাছে গিয়ে নতমস্তকে বলতে হবে, শিক্ষায় অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ করে আমরা ঠিক করিনি। ভবিষ্যতে আর এই ভুল হবে না।” মানুষের কাছে হারানো বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরে পেতে গেলে সত্যকে সহজ করে বলার যে নিদান বুদ্ধবাবু দিয়েছেন, তাকে খোলাখুলিই স্বাগত জানাচ্ছেন সিপিএম এবং বামফ্রন্টের নেতারা।
বস্তুত, নিজের দলিলেও অনিলায়নের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন বুদ্ধবাবু। সে খবর আনন্দবাজারে প্রকাশিতও হয়। এ বার সম্মেলনের মঞ্চে আরও সরাসরি তোপ দেগেছেন প্রয়াত অনিলের ঘনিষ্ঠ সুহৃদ বুদ্ধবাবু। বলেছেন, শিক্ষা ক্ষেত্রে কিছু কিছু জায়গা বামেরা কুক্ষিগত করে রেখেছিল। এই হস্তক্ষেপ সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় ছিল। তৃণমূলের আমলে শিক্ষাকে সরকারি এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত করার জন্য বামেদের আন্দোলন করতে হবে। কিন্তু তার আগে মানুষকে বলতে হবে, আমরা যা করেছিলাম, তা-ও ঠিক ছিল না! ফের সরকারে ফিরলে শিক্ষা ক্ষেত্রে
ওই ভুল আর হবে না। কেবল শিক্ষাকে কুক্ষিগত করার চেষ্টাই নয়, প্রাথমিক থেকে এক সময়ে ইংরেজি তুলে দেওয়ার ভুলও এ দিন ফের কবুল করে নিয়ে বুদ্ধবাবু বলেছেন, মানুষের মধ্যে ইংরেজি মাধ্যমে ছেলেমেয়েদের পড়ানোর প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। এই কথা বুঝতে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছিলেন। পরে ভুল সংশোধন করে প্রাথমিকে ইংরেজি ফিরিয়ে আনলেও অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল, মন্তব্য করেছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী।
শিক্ষা ক্ষেত্রে ছড়ি ঘোরানোর ভুল প্রকাশ্যে কবুল করে নেওয়ার জন্য দলীয় নেতা-কর্মীদেরও পরামর্শ দিয়েছেন সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য বুদ্ধবাবু। আর নন্দীগ্রামের ক্ষেত্রে একেবারে নিজের দিকে সমস্ত দায় টেনে নিয়েছেন। নন্দীগ্রামে গুলি চালনা, গোটা ঘটনাপ্রবাহের জন্য বামেদের ভাবমূর্তির ক্ষতি এ সব নিয়ে বহু আলোচনা গত ৮ বছর ধরে সিপিএমের অন্দরে হয়েছে। বুদ্ধবাবু নিজে এবং সিপিএম নেতৃত্বও ভুল স্বীকার করেছেন। তবু বিতর্ক থামেনি! এ বারের সম্মেলনের মুখেও বহিষ্কৃত সিপিএম নেতা তথা তমলুকের প্রাক্তন সাংসদ লক্ষ্মণ শেঠ তোপ দেগেছেন, বুদ্ধবাবু দায় এড়াতে দলের তদানীন্তন স্থানীয় নেতৃত্বকে কাঠগড়ায় তুলেছেন! এ সবের পরে বুদ্ধবাবু এ দিন আর কোনও জল্পনা বা ভিন্ন ব্যাখ্যার অবকাশ রাখেননি। সরাসরি বলেছেন, নন্দীগ্রামে অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটেছিল। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলেছিল দিনের পর দিন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারার ব্যর্থতা তিনি মেনে নিচ্ছেন। নন্দীগ্রামের দায়িত্বে অনেকেই ছিলেন। কিন্তু সরকার ও দলের যে নির্দিষ্ট অংশ সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্বে ছিল, তিনি তাদের এক জন। এবং তিনিই সব ভুলের জন্য দায়িত্ব স্বীকার করছেন। চেষ্টা করেও বামেদের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া আটকাতে পারেননি। মানুষকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এর দায় তাঁরই, মেনে নিয়েছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী।
সিঙ্গুরেও পরিস্থিতি মোকাবিলায় ত্রুটির কথা মানতে কুণ্ঠা করেননি বুদ্ধবাবু। অনেক দূর এগিয়ে গিয়েও সিঙ্গুরে যে পিছিয়ে আসতে হয়েছিল, তার জন্য আক্ষেপ করেছেন। রতন টাটার অবস্থান ছিল, অবাঞ্ছিত অতিথি হয়ে থাকবেন না! শেষ দিকে টাটার মনোভাব বদল যেমন তাঁরা ধরতে পারেননি, তেমনই বুদ্ধবাবুর আরও ব্যাখ্যা তাঁর সরকার যখন নিরাপত্তা দিতেই পারছে না, তখন আর কী ভাবে তিনি টাটাদের বলতেন, আপনারা থাকুন!
তবে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের ব্যতিক্রম’ সত্ত্বেও শিল্পায়নের নীতিতে ভুল মানতে এখনও নারাজ বুদ্ধবাবু। সম্মেলনে এ দিনও তাঁর যুক্তি, রাজ্যে মোট কৃষিজমির পরিমাণ ১ কোটি ৩৫ লক্ষ একর। এর মধ্যে মাত্র ১% জমি লাগতো বাম আমলে নেওয়া শিল্পের পরিকল্পনার জন্য! লক্ষ লক্ষ বেকার, শিক্ষিত ছেলেমেয়ের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে জমি নেব না, এই নীতি আঁকড়ে থাকা যায় না বলে এ দিনও সওয়াল করেছেন বুদ্ধবাবু। বলেছেন, তাঁরা সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছেন এবং নেবেন। কিন্তু ভবিষ্যতে ক্ষমতায় এলে ভুল এড়িয়ে শিল্পের পথেই যে বামেদের এগোতে হবে, তা-ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন।
বিতর্কে অংশ নিয়ে কলকাতা সিপিএমের এক নেত্রী বলেছিলেন, জেলা কোটা থেকে অনেক মন্ত্রী সুযোগ পেয়েছিলেন, যাঁরা কাজ করতেন না! দক্ষিণ ও উত্তর ২৪ পরগনার দুই নেতা সমালোচনা করেছিলেন বাম সরকারের আমলাতান্ত্রিক হয়ে পড়ার প্রবণতার। এ সবেরই উত্তর দিয়েছেন বুদ্ধবাবু। একই সঙ্গে তাঁর কথায় ধরা পড়েছে, উদ্দেশ্য ঠিক থাকলেও সিদ্ধান্তের প্রয়োগের ভুলের জন্য তাঁকে আজীবন সমালোচনা শুনে যেতে হবে! সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের ভুল মানতে গিয়ে তাই বুদ্ধবাবু বলেছেন, ঘটনার পরেই তিনি সমালোচনা শুনেছেন। এখনও শুনছেন। ভবিষ্যতেও শুনে যাবেন! মাথা নিচু করে ভুল মেনেই মানুষকে বলবেন, কোনটা ঠিক করেছিলেন, কোনটা বেঠিক! এ সবই যে অতীতের বিশ্লেষণ, নিজেই মনে করিয়েছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্যে তৃণমূলের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার করার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, “কোনও কিছুই খসে পড়ে না। খসাতে হয়! তৃণমূলকেও সে ভাবে খসিয়ে দিতে হবে বামেদের! কোন পথে? বুদ্ধবাবু শেষ করেছেন এই বলে যে, ভবিষ্যতের কর্মসূচি সূর্য বলবে (সূর্যকান্ত মিশ্র)! নতুন রাজ্য কমিটিই দিশা দেখাবে।” অমোঘ কিছু সত্য কবুল করেই অন্তরালের পথে আরও এগিয়ে গেলেন বুদ্ধদেব?