বুধবার আটক হওয়া মোষ। ডান দিকে, গত বৃহস্পতিবার রাতে আয়োজন চলছে ফেনসিডিল পাচারের। রানিনগরে গৌতম প্রামাণিক ও বিশ্বজিৎ রাউতের তোলা ছবি।
পাচার বন্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে— দিন পনেরো আগে ৯৮ তম প্রশাসনিক বৈঠকে মুর্শিদাবাদে এসে মুখ্যমন্ত্রী এ হেন কড়া বার্তা দিয়েছিলেন। কিন্তু, বার্তা আর হুঁশিয়ারি সার! মঙ্গলবার গভীর রাতে জেলার রানিনগর সীমান্তে গরু, মোষ মিলিয়ে ১২৬টি গবাদি পশু আটকের ঘটনা জেলার পাচার-চিত্রকে ফের বেআব্রু করেছে।
বিএসএফ সূত্রে খবর, ১৩০ ব্যাটেলিয়নের জওয়ানেরা মঙ্গলবার রাত একটা থেকে প্রায় তিন ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে পশুগুলি আটক করে। ব্যাটেলিয়নের সেকেন্ড ইন কমান্ড জিআর হাঁসদা জানান, রাতের অন্ধকারে ওই পশুগুলি সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে পাচারের চেষ্টা করছিল পাচারকারীরা। জওয়ানেরা বিশেষ অভিযান চালিয়ে সেগুলি আটক করেছে। তবে কোনও পাচারকারী ধরা পড়েনি।
মুখ্যমন্ত্রীর কড়া বার্তার পরেও পাচারে লাগাম টানা যাচ্ছে না কেন? মুখ খুলতে চাননি জেলা পুলিশ কর্তারা। সিপিএম, কংগ্রেসের মতো বিরোধী দলের নেতাদের অভিযোগ পাচারে মদত দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে জেলা পুলিশের একাংশের বিরুদ্ধেই। ‘‘পুলিশ কর্তারা কোন মুখে পাচার নিয়ে মন্তব্য করবেন’’— বলছেন এক কংগ্রেস নেতা। কিছু দিন আগেই এক কংগ্রেস বিধায়ক পাচারে জঙ্গি-যোগের অভিযোগ তুলে খোদ মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। জেলা তৃণমূলের কিছু নেতার বিরুদ্ধেও পাচারে মদত দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
ঘটনা হল, পাচার-প্রসঙ্গে বিএসএফের কর্তারাও এ দিন নজিরবিহীন ভাবে পুলিশের উপরে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন। তাঁদের দাবি, জেলায় যেটুকু পাচার রোখা গিয়েছে সেটা তাঁদের জন্য সম্ভব হয়েছে। বিএসএফের সেকেন্ড ইন কমান্ড জিআর হাঁসদা-র অভিযোগ, ‘‘প্রশাসনের তরফে কোনও সহযোগিতা পাচ্ছি না। সীমান্ত থেকে অন্তত ৫০০ মিটার এলাকায় পাট চাষ বন্ধ করতে প্রশাসনের কাছে বহুবার আবেদন করেছি। কাজের কাজ কিছুই হয়নি।’’ বিএসএফের অনেকেরই অভিযোগ, বছর খানেক আগেও জেলার পুলিশ পাচার রুখতে বড় ভূমিকা নিয়েছিল। এখন পাচার নিয়ে ব্যবস্থা দূরে থাক পুলিশের মদতেই অনেক এলাকায় পাচার চলছে।
বিএসএফ সূত্রে জানা গিয়েছে, সীমান্তে পাটের মত লম্বা গাছ থাকার ফলে নজরদারি চালাতে অসুবিধা হয়। কয়েক মিটার দূর দিয়ে পাচার হলেও বোঝা দায়! এক কর্তার কথায়, ‘‘আমরা চাষিদের ক্ষতি চাই না। কিন্তু সীমান্তের নিরাপত্তার বিষয়টি আন্তর্জাতিক। সেক্ষেত্রে চাষিদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বিকল্প চাষের ব্যবস্থা করতে পারে প্রশাসন।’’
পুলিশের নজরদারি উজিয়ে এত গবাদি পশু কী করে সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছল, উঠছে সে প্রশ্নও। রানিনগর সংলগ্ন সীমান্তে গবাদি পশুর কোনও হাট নেই। প্রশাসনের একটি সূত্রে খবর, সাগরদিঘি বা ওই এলাকার হাট থেকে গাড়ি বোঝাই হয়ে গরু গভীর রাতে সীমান্তে পৌঁছয়। সেখান থেকে হাঁটিয়ে গরুগুলি বাংলাদেশে পৌঁছে দেওয়া হয়। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বাংলাদেশে এখন এক জোড়া গরু বা মোষের দাম প্রায় দেড় লক্ষ টাকা। এক জোড়া গরু গ্রাম থেকে ‘নো ম্যানস্ ল্যান্ডে’ পৌছে দিলেই রাখালের হাতে মেলে দু’থেকে তিন হাজার টাকা। গরুর পাশাপাশি রানীনগর সীমান্তে ইদানীং ফেনসিডিল পাচারের রমরমা বেড়েছে। গত এক মাসে বিএসএফ এই সীমান্ত এলাকা থেকেই প্রায় চার হাজার বোতল ফেনসিডিল আটক করেছে।
বিএসএফের পর্যবেক্ষণ, এলাকায় ঢোকার মুখে দু’টি ব্রিজে পুলিশ টহল দিলেই ভাগীরথীর পূবর্পাড়ের সীমান্তে গরু ঢোকা বন্ধ হবে। ‘‘সেটা পুলিশের কাজ। পুলিশ যতক্ষণ সক্রিয় না হবে, ততক্ষণ সত্যিই কিছু করার নেই!’’—বলছেন বিএসএফের এক কর্তা। জেলা পুলিশ কর্তাদের অবশ্য দাবি, বিষয়টির উপরে কড়া নজর রাখা হচ্ছে। ডোমকলের এসডিপিও অমরনাথ কে বলেন, ‘‘আবহাওয়ার কারণে আর বাংলাদেশে চাহিদা বাড়ায় পাচার আগে কিছুটা বেড়েছিল। বিষয়টি এখন নিয়ন্ত্রণে। আমরা কড়া নজর রাখছি।’’
সেই নজর এড়িয়ে ১২৬টা মোষ সীমান্তে পৌঁছল কী করে?
উত্তর মেলেনি।