অতি উত্তম
‘আমি অভিজাত পরিবারের গিন্নি ভদ্রমহিলা বলছেন, আমি আর বাড়ি ফিরব না৷ তাঁকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে বাড়ি পাঠাতে চেষ্টা করছেন উত্তমকুমার! ভদ্রমহিলা সটান কৃষ্ণনগর থেকে উত্তমকুমারের গাড়ি ফলো করে গিয়েছেন কলকাতার স্টার থিয়েটারে, দেখেছেন ‘শ্যামলী’ নাটক৷ তার পরে মেক-আপ রুমে এক রকম জোর করেই দেখা করেছেন উত্তমকুমারের সঙ্গে৷ তার পরেই তাঁর ওই জেদ, সংসারে আর ফিরবেন না৷
‘সবার উপরে’ ছবির শুটিং হয়েছিল কৃষ্ণনগরে, সেই সূত্রেই এই নাছোড় ভদ্রমহিলার আখ্যান৷ তার পরে বর্ধমানের অভিজ্ঞতা, ১৯৫৬-র কথা, সবে উত্তম স্টার হয়ে উঠছেন৷ বর্ধমান সিনেমার কর্ণধার তাঁকে নিয়ে চলেছেন বর্ধমানে, সংবর্ধনা দিতে৷ উত্তম তাঁর আত্মজীবনী ‘আমার আমি’-তে লিখছেন, ‘তারপর আমাদের গাড়ি যখন বর্ধমানে ঢুকল, গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়েই তো আমাদের চক্ষুস্থির৷ অগণিত মানুষের ভিড় সেই সিনেমা হাউসের মাঠে৷ কৌতূহলী মন নিয়ে ভাবছি, কী ব্যাপার! কোনও গণ্ডগোল হয়নি তো! আমাদের গাড়ি হাউসের পিছন দিকে ঢোকা মাত্র একদল লোক একেবারে আমাদের গাড়ির ওপর এসে পড়ল৷ আর আমার কানে ভেসে আসতে থাকল ‘জয় উত্তমদা কি জয়’ শ্লোগান৷’
এমনই নানা ঘটনা, সাহেবগঞ্জে ‘জতুগৃহ’র শ্যুটিং বা উত্তরবঙ্গে বন্যাত্রাণে গান গাইতে যাওয়া ক্যামেরায় তুলে রেখেছিলেন আলোকচিত্রী সুকুমার রায়৷ পুরনো দিনের কয়েকটি সিনেমা পত্রিকার জন্য কাজ করতে গিয়ে উত্তমকুমারের ছবি তোলার কাজটা শুরু করেছিলেন তিনি৷ আর তখনই বুঝেছিলেন, পর্দায় যেমন, পর্দার বাইরেও তেমনই আত্মবিশ্বাসে ঝলমলে উত্তমকুমার। ‘‘ছবি তুলতে গেলে কখনও বাধা দেননি উত্তমবাবু। কখনও বলেননি, দাঁড়ান, একটু গোছগাছ করে আসি। অবলীলায় পোজ দিতেন। হয়তো বা আলতো হাত চালিয়ে চুলটা একটু ঠিক করে নিলেন, ব্যস ওইটুকুই। ওরই মধ্যে একটা মুহূর্তের জন্ম হয়ে যেত।’’ তেমনই কয়েকটি অবিস্মরণীয় মুহূর্ত সঙ্গের ছবিগুলিতে৷ সাহেবগঞ্জে স্টিমার থেকে উঠে আসছেন উত্তমকুমার, উত্তরবঙ্গে বন্যাত্রাণে গিয়ে পঙ্কজকুমার মল্লিক আদর করছেন উত্তমকুমারকে কিংবা ‘বনপলাশীর পদাবলী’-র শ্যুটিংএ৷
অপরাজিত
‘স্বামীর সঙ্গে আবার আগের মতো থাকতে পারব তো? আপনি ডাক্তারবাবুকে একবার জিজ্ঞেস করে দিন প্লিজ, দিদি।’ যাঁকে প্রশ্নটা করা হচ্ছে, স্তনের ক্যানসারের অস্ত্রোপচার হয়েছে তাঁর সদ্য। যাঁকে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে, তিনিও একই অস্ত্রোপচার সেরে সে দিন বাড়ি ফিরছেন। মুম্বইয়ের এক হাসপাতালে এই যন্ত্রণা, লজ্জা, লড়াই আর বন্ধুতার উপাখ্যান তাঁর অনঘ (আনন্দ) উপন্যাসে নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই তুলে এনেছেন দীপান্বিতা। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে তিনি গেঁথে তুলেছেন সেই সব মুহূর্ত, যার চিন্তাও মানুষকে অসাড় করে দেয়। লেখনীর কৌশলই সেখানে এক মাত্র বিবেচ্য নয়। বরং যে ভাবে মারণ রোগের চোখের দিকে সাহসের সঙ্গে চেয়েছেন তিনি, যে সহমর্মিতায় চেয়েছেন অন্য আক্রান্তদের দিকে, তা শ্রদ্ধার উদ্রেক করে।
শেষ নাহি যে
আবু সৈয়দ আইয়ুব, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় থেকে রম্যাঁ রল্যাঁ— সাহিত্যের দিকপাল সব ব্যক্তিত্ব প্রত্যেকেই নিজের মতো করে রবীন্দ্রচর্চায় নিয়োজিত থেকেছেন বরাবর। সেই চর্চার ধারাতেই নতুন সংযোজন বিশ্বভারতীর অধ্যাপক মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রনাথ: আশ্রয় ও আশ্রম (গাঙচিল)। ‘আশ্রয়’ পর্বের প্রবন্ধগুলিতে মানবেন্দ্র বুঝতে চেয়েছেন রম্যাঁ রল্যাঁ, লেআঁদ্র ভাঈয়া বা রণজিৎ গুহরা কী ভাবে রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সৃষ্টিকে দেখতে চেয়েছেন। রয়েছে অধ্যাপক উইলিয়ম রাদিচের ইংরেজি গীতাঞ্জলির বিন্যাস ভাবনা সংক্রান্ত আলোচনাও। ‘আশ্রম’ পর্বের প্রবন্ধে ঘুরে-ফিরে এসেছে শান্তিনিকেতনের বহু চেনা-অচেনা প্রসঙ্গ। বইয়ের একেবারে শেষ পর্বে রয়েছে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় ও প্রশান্তকুমার পালের রবীন্দ্র-জীবনীর তুলনামূলক আলোচনা। তবে যে সব কারণে পাঠ বাদা পায় তার অন্যতম হল, গদ্যের অহেতুক জটিলতায় প্রবন্ধগুলি কোথাও যেন ভারাক্রান্ত।
ছড়ানো ইতিহাস
হয়তো কিছু গল্পও লিখেছেন তিনি। কিন্তু মূলত ছড়াকার হিসেবেই মেদিনীপুরের অশোককুমার দে-কে চেনেন পাঠকেরা। তাঁর অধিকাংশ ছড়ার বিষয় ইতিহাসের নানা চরিত্র বা ঘটনা। কখনও তা সাম্প্রতিক, কখনও বহু পুরনো ইতিকথা। সেই ১৯৮৭ সাল থেকে দেশের নানা ঘটনা তিনি ধরেছেন ছড়ায়। এটাই তাঁর বিশেষত্ব, যে কারণে তিনি চিহ্নিত হয়ে আছেন পাঠকমহলে। প্রায় তিন দশক ধরে লেখা তেমনই ১০১টি ছড়া সাজিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে সংকলন ছড়ায় মোড়া ইতিহাসের ঘোড়া। প্রস্তর যুগ থেকে ভারত ছাড়ো আন্দোলন, গৌতম বুদ্ধ থেকে সম্রাট অশোক, মির কাশিম থেকে নীল বিদ্রোহ বা ক্ষুদিরামের আত্মত্যাগ— ছড়ায় ঠাঁই পেয়েছে কত না ঘটনা। অশোকবাবুর আশা, ছড়ার ছন্দে বলা ইতিহাস কচিকাঁচাদের আকৃষ্ট করবে। গল্পগুলো মনে গেঁথেও যাবে তাদের।
অপূর্ব ছড়া
কিছু-কিছু কথা লোকের খুব মনে ধরে যায়, মুখে মুখে ফেরে। অনেকেই হয়তো খোঁজ রাখেন না, কার মাথায় এ সুতোর জাল বোনা হয়েছিল। যেমন, ‘স্কুলে কেন বেংগলিটা পড়ায় না ইংলিশে?’ অনেকেরই চেনা কথা। কিন্তু অপূর্ব দত্ত নামটা শুনলে তাঁদের অনেকেরই ভুরু কুঁচকে যেতে পারে। সে আবার কে হে? নবীন কিন্তু তিনি নন। রিটায়ার করার বয়স পেরিয়েছে। পাক্কা তিরিশটা ছড়ার বই, ছ’টা কবিতার। গপ্পো-উপন্যাস লিখেছেন। কিন্তু বাংলা সাহিত্য নিয়ে যাঁরা নিয়মিত চর্চা করেন, এমন লেখক-পাঠক-প্রাবন্ধিকেরা তাঁকে চেনেন এই সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছড়াকার হিসেবেই। রানাঘাটের সেই ছড়াকারই এ বার ত্রৈমাসিক কথাকৃতি পত্রিকার কেন্দ্রীয় চরিত্র। একক চরিত্র বললেও ক্ষতি হয় না। নদিয়ার বেথুয়াডহরি থেকে নীলাদ্রিশেখর সরকারের সম্পাদনায় প্রকাশিত পত্রিকাটি নানা বিভঙ্গে ধরেছে কবির জীবন ও আলেখ্য। অনুপ রায়ের অপূর্ব-স্কেচের পাশাপাশি ধ্রুব এষর করা প্রচ্ছদও চোখ টানে।
শ্রী-রামপুর
ফরাসি এসেন্সের সুরভি আজও যে শহরের হাতায় মাখানো, তার নাম চন্দননগর। কিন্তু কে জানত, আড়াই শতক আগে ইংরেজদের তাড়া খেয়ে সেই ফরাসিরাই দিনেমারদের দখলে থাকা শ্রীরামপুরে এসে ঠাঁই নিয়েছিল? এ রকম কিছু জরুরি তথ্য এবং মার্গ সঙ্গীত নিয়ে স্থানীয় ইতিহাস সংকলন করে শ্রী নামে পত্রিকা প্রকাশ করছে ‘শ্রীরামপুর হেরিটেজ রেস্টোরেশন ইনিশিয়েটিভ’। সাধু প্রচেষ্টা, সন্দেহ নেই। তবে লেখা সংগ্রহ, বাছাই থেকে সম্পাদনা, বাঁধাই থেকে প্রচ্ছদ— সবেতেই খানিক পেশাদারিত্বের প্রয়োজন ছিল।
বুনো লেন্স
কলেজ জীবনের আগে থেকেই পাহাড়ে চড়ার নেশা পেয়ে বসেছিল। ধাপে-ধাপে যা সদ্য তরুণটিকে ছবি তোলার নেশা ধরিয়ে দেয়। প্রকৃতিকে লেন্সের চোখ দিয়ে দেখার আগ্রহ বাস্তবায়িত করাটা অবশ্য তত সহজ ছিল না। টিউশনের টাকা জমিয়ে কিনেছিলেন জীবনের প্রথম এসএলআর ক্যামেরা। ‘ওয়াইল্ড লাইফ’ তোলার শখটা যখন ক্রমে চেপে বসল, দরকার পড়ছিল আরও ভাল ক্যামেরা, তুখোড় লেন্সের। সে সব জোগাড় করতে গিয়ে মা-দিদির গয়না বন্ধক রাখতে হয়েছিল। পরে বাড়ির একতলাটাও বিক্রি করতে পিছপা হননি সরকারি চাকুরিজীবী বাবা। সেই চেষ্টা বিফলে যায়নি। বরং এখন ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফিকেই নেশা থেকে পেশা করে তুলেছেন বারাসতের ধৃতিমান মুখোপাধ্যায়। চষে ফেলেছেন দুনিয়া। আজ এখান তো, কাল সেখান। জানালেন, গত দশ বছরে বারাসতের বাড়িতে বাবা-মায়ের কাছে টানা পাঁচ দিন থেকেছেন কি না সন্দেহ। এই ক’বছরে তুলনায় পরিচিত-স্বল্প পরিচিত জীবজন্তুর ছবি তুলেছেন অসংখ্য। ছুটেছেন আফ্রিকা, পাপুয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মণিপুর, হিমায়লের নানা প্রান্তে। বহু ছবি বেরিয়েছে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, লোনলি প্ল্যানেটস, বিবিসি ওয়াইল্ড লাইফ, নিউইয়র্ক টাইমসে। বছর তিনেক হল, তিন বন্ধুর সঙ্গে মুম্বই থেকে প্রকাশ করছেন বন্যপ্রাণ ও প্রাণী সংক্রান্ত পত্রিকা ‘সেভাস’। মলদ্বীপে সমুদ্রের তলায় ছবি তুলে দু’দিন বাড়ির ভাত খেয়েই আপাতত তিনি চলে গিয়েছেন অসমে। সেখানে বানভাসি কাজিরাঙ্গার জীবজন্তুর ছবি তুলবেন, এটাই এখন বাসনা।