এই মারণ সিগারেটের কারবার চুটিয়ে চলছে শহরে।—নিজস্ব চিত্র।
নেশা মুক্তির পথ বাতলে দেবে অমুক প্রতিষ্ঠান। সঙ্গে একটা যোগাযোগ নম্বর!
শহর বা গ্রামের দিকে চলার পথে দেওয়ালে রং তুলি দিয়ে আঁকা অথবা কাগজের ছোটখাট এমন বিজ্ঞাপন প্রায়ই নজরে আসে। দুবরাজপুরের রাস্তায় হঠাৎ-ই একটু ভিন্ন আঙ্গিকের বিজ্ঞাপন নজরে এল। সেটা নেশাগ্রস্তদের জন্য একটা রিহ্যাব ক্যাম্পের নাম ও ঠিকানা। যেখানে ড্রাগের নেশায় আসক্তদের রেখে চিকিৎসা করে তাঁদের সুস্থ করার কথা বলা হয়েছে।
এই মুহূর্তে দুবরাজপুর শহরের কিছু পরিবারের জন্য অতিপ্রয়োজনীয় বিজ্ঞাপন— সন্দেহ নেই। পরিবারে থেকে পরিবারে নেশা আসক্তদের সংখ্যা যে ক্রমশ রকেট গতিতে বেড়েই চলছে! নেশা মানে, ‘চিনির’ নেশা। ব্রাউন সুগারের নেশা। এলাকায় ব্যাপক পোস্তচাষের ক্ষতিকারক প্রভাব যে শহরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। পোস্তর আঠার সঙ্গে কেমিক্যাল মিশিয়ে তৈরি ব্রাউনসুগার মিশ্রিত সিগারেটের কারবারে ছেয়ে গিয়েছে শহর ও তা পাশের অঞ্চলগুলি। তাতেই আসক্ত হয়ে পড়ছে তরুণেরা। নেশা মুক্তির উপায় খুঁজতে যে এমন বিজ্ঞাপনই খুঁজবেন নেশাসক্তদের পরিজনেরা তাতে আর আশ্চর্য কী!
কিন্তু লাখ টাকার প্রশ্নটা হল খোঁজ খবর নিয়ে রিহ্যাব ক্যাম্পে পাঠালেই কি নেশা মুক্তি ঘটছে?
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাস্তব অভিজ্ঞতা অন্তত তা বলছে না। আর সেই চেষ্টা করার সামর্থ্য যে পরিবারে নেই তাঁদের পরিস্থিতি আরও করুণ। কিন্তু নেশার কবল থেকে মুক্তির পথ কী। উত্তরটা অজানা দুবরাজপুরের মানুষের কাছে।
কী ভাবে ছড়াচ্ছে এই নেশা?
এলাকা সূত্রে জানা গিয়েছে, এলাকা ও বাইরে থাকে আসা এক শ্রেণির যুবক টাকার জন্য এই মারণ সিগারেটের কারবার চুটিয়ে চালাচ্ছে। পুলিশ সূত্র ও এলাকাবাসীর অভিজ্ঞতা বলছে দুবরাজপুরের বেশ কিছু মহিলাও টাকার লোভে কারবারিদের মধ্যস্থদের ভূমিকা নিচ্ছে। কারবারে জড়িয়ে রয়েছে কিছু প্রভাবশালী পরিবারের যুবক। যাঁরা ইতিমধ্যেই নেশার কবলে পড়েছেন। ফলে রমরমিয়ে চলছে ব্রাউনসুগার মিশ্রিত সিগারেট কারবার কার্যত বিনা বাধায়। সিগারেটের সংক্ষিপ্ত নাম বিএস। একটি সিগারেটের দাম ৩০০-৫০০ টাকা।
শহরের যে সব তরুণ বা যুবা নেশার কবলে পড়েছেন তাঁরা যে সকলেই শক্তিশালী আর্থিক পরিবার থেকে এসেছেন এমন নয়, বহু গরিব পরিবারের তরুণ সদস্যরা নেশার কবলে। সচ্ছল পরিবারের তরুণরা নেশার কবলে পড়লে অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানের নেশামুক্তির জন্য মোটা টাকা খরচ করে, অনেককেই রিহ্যাব ক্যাম্পে পাঠিয়েছেন। যদিও সব ক্ষেত্রে ফল পাওয়া যায়নি। বেশ কিছু দিন রিহ্যাব ক্যাম্পে থাকার পরও বেশ কয়েকজন নেশাসক্ত ফের মাদক সিগারেট সেবন শুরু করেছেন। বা বন্ধুবান্ধবকে নতুন করে নেশার রাস্তায় টেনে এনেছেন, এমন উদাহরণও বহু রয়েছে। অন্য দিকে গরিব পরিবারের কেউ নেশার কবলে পড়লে ফল আরও মারাত্মক হচ্ছে। নেশা করার জন্য ওই পরিমাণ টাকা জোগাড় করাটাই সমস্যার হয়ে দাঁড়াচ্ছে নেশাগ্রস্তদের কাছে। তখন পরিবারের টাকাপয়সা ছিনিয়ে নেওয়া বা ঘরের জিনিসপত্র, গহনা বিক্রি করে দেওয়া, এমনকী প্রয়োজনে চুরির রাস্তা নিতেও পিছুপা হচ্ছে না নেশাগ্রস্তরা। এ হেন পরিস্থিতিতে বহু পরিবারে চরম অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখা দিয়েছে। কী করলে পরিবারের ওই নেশাগ্রস্থ সদস্যকে নেশা মুক্ত করানো যায় সেই রাস্তা খুঁজে পাচ্ছেন না অভিভাবকেরা। দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে তাঁদের জীবন।
কেমন সেই ছবি?
বিধবা মা, প্রতিবন্ধী বোন ও নিজে বিড়ি বেঁধে যা রোজগার হত সেই দিয়েই সংসার চালাতেন এক যুবক। কিন্তু বছর খানেকেরও বেশি সময় ধরে বিএস সিগারেটে আসক্ত হয়ে পড়েছেন তিনি। নিজে এখন আর রোজগার করার জায়গায় নেই। বোন এবং মা যেটুকু আয় করেন সেটাই নেশায় উড়ে যাচ্ছে। এক বিধবা মহিলা বলছেন, ছেলেটা সবে রোজগার করতে শুরু করেছিল। বছরখানেক আগে দেখালাম কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে পড়েছে ছেলেটা। পরে জানলাম, নেশার সিগারেট খায়। নেশার টানে বাড়ির সব কিছু বিক্রি করে দিতে শুরু করেছিল। বহু চেষ্টা করে রিহ্যাব ক্যাম্পে পাঠিয়েছিলাম। এখন কিছুটা ভাল। তবে যে কোনও দিন আবার হয়তো নেশার কবলে পড়ার সেই আশঙ্কা রয়েছে!
ভাঙা লোহার টুকরোর কারবারে জড়িত, এক ভদ্রলোকের চারটি মেয়ে-সহ ছয় সন্তান। সংসারে বাবাকে কিছুটা সাহায্য করছিল বছর উনিশের বড় ছেলে। কয়েক মাস সে মাদক সিগারেটের নেশার কবলে পড়েছে। এখন সে বাবাকে সাহায্য তো করেই না, উল্টে বাড়ির জিনিসপত্র বিক্রি করা শুরু করেছে। নেশার টানে ঘুমন্ত স্ত্রী-র কান থেকে সোনার কানের দুল খুলে বিক্রি করার মতো ঘটনাও ঘটছে আকছার। সঙ্গে এলাকায় বাড়ছে চুরি বা অপরাধ করার প্রবণতা। নেশাগ্রস্তরা জানাচ্ছেন, যখন নেশা চাপে তখন হাত পা টানতে শুরু করে, শরীরে অদ্ভুত কষ্ট শুরু হয় যতক্ষণ না সেই সিগারেটে টান পড়েছ। তার কেউ চুপচাপ আচ্ছন্নের মতো হয়ে যায়, কেউ বা উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তখনই শহরের অলিগলির আড়াল, অন্ধকার জায়গা বেছে নিয়ে চলে বিশেষ সিগারেটে টান।
স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, বিএস নামক সিগারেটের নেশা করছেন কয়েকশো তরুণ। দুবরাজপুরের পুরপ্রধান পীযূষ পাণ্ডে ও শাসকদলের এক কাউন্সিলর প্রভাত চট্টোপাধ্যায় বলছেন, নেশা করার প্রবণতা মারাত্মক আকার নিয়েছে। এমনটা চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য খুবই খারাপ সময় অপেক্ষা করছে। এত যখন খারাপ পরিস্থিতি তাহলে পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকাটা কী বা কীভাবে এবং কোন পথে এই মাদক সিগারেট নেশাগ্রস্তদের হাতে পৌঁছচ্ছে। পুলিশ বলছে, চেষ্টা করলেও খুব একটা ফল মিলছে না। নেশাগ্রস্ত ধরে এনে থানায় রাখা মুশকিল। আর মাদক সিগারেট সমেত দু’চারজনকে ধরতে পারলেও লাগাম পরানো যায়নি। স্থানীয় বাসিন্দারা অবশ্য বলছেন, পুলিশ বা সংশ্লিষ্ট দফতর সঠিক ভূমিকা পালন করতেই পারেনি।
দুবরাজপুর থানার পুলিশ এক আধবার এ ধরনের সিগারেটের প্যাকেট বাজেয়াপ্ত করেছিল। কিন্তু শিকড় পর্যন্ত পৌছয়নি। বা পৌঁছনোর চেষ্টা করেনি পুলিশ।