গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
বঙ্গ রাজনীতি আপাতত ‘শুভেন্দুময়’। বুধবার দুপুরের পর থেকে রাজ্য রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে বিজেপির বৈঠকে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর মন্তব্য ঘিরে। বিজেপি তো বটেই, শুভেন্দুকে নিয়ে আলোচনা জারি রয়েছে তৃণমূলের নেতাদের মধ্যেও। বাদ নেই সিপিএমও। এক এক দলের এক এক নেতা তাঁদের মতো করে শুভেন্দুর কথার ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। তবে সাংগঠনিক শৃঙ্খলার প্রশ্নে বিজেপি যে ‘আপসহীন’ অবস্থান নিয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে সিপিএমের মধ্যে। আট বছর আগের প্রসঙ্গ টেনে প্রবীণ সিপিএম নেতাদের অনেকেই নিজেদের আলোচনায় বলছেন, সেই সময়ে ভোটের কথা ভেবে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা, দলের লাইন ইত্যাদি প্রশ্নে ‘শিথিলতা’ দেখানো হয়েছিল। যার খেসারত এখনও দিতে হচ্ছে এবং হবেও।
উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে ভরাডুবির পরেও বঙ্গ সিপিএমের বিভিন্ন স্তরের আলোচনায় ২০১৬ সালের ‘ভুল’ নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং হচ্ছে।
বিজেপির বৈঠকে শুভেন্দুর দু’টি বক্তব্য নিয়ে মূলত ‘বিতর্ক’ তৈরি হয়েছে। এক, ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ’ বলার দরকার নেই। যারা দলের সঙ্গে থাকবে, তাদের সঙ্গেই দল থাকুক। দুই, সংখ্যালঘু মোর্চারও কোনও প্রয়োজন নেই। প্রথম বক্তব্য নিয়ে বিতর্কের কারণ নরেন্দ্র মোদীর স্লোগানকে চ্যালেঞ্জ করে তা বদলে দেওয়া। কারণ, সেই স্লোগান ‘বিজেপি নেতা’ নরেন্দ্র মোদীর নয়। ‘প্রধানমন্ত্রী’ নরেন্দ্র মোদীর। অর্থাৎ, কেন্দ্রীয় সরকারের স্লোগানকে চ্যালেঞ্জ করে বসেছেন কেন্দ্রের শাসকদলের একটি রাজ্যের নেতা তথা বিরোধী দলনেতা। পাশাপাশিই, সংখ্যালঘু মোর্চা তুলে দেওয়ার বিষয়টিকে সাংগঠনিক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করা বলেই মনে করেছে পদ্মশিবির। বিজেপি একটি ‘সংগঠিত’ পার্টি। তাদের সাংগঠনিক কাঠামো রয়েছে। কে কী বলতে বা করতে পারেন, তার এক্তিয়ারও নির্দিষ্ট করা রয়েছে দলে। শুভেন্দুর ওই বক্তব্যকে বিজেপি তাই ‘লঘু’ করে দেখেনি। পদ্মশিবির সূত্রে খবর, শুভেন্দুর বক্তব্য নিয়ে আলোড়ন শুরু হতেই দিল্লি থেকে বিরোধী দলনেতার কাছে একাধিক ফোন আসে। তার ফলেই শুভেন্দুকে তাঁর এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে পোস্ট করে সাফাই দিতে হয়। রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারও স্পষ্ট জানিয়ে দেন, শুভেন্দু তাঁর ‘ব্যক্তিগত’ মত বলেছেন। দল তা ‘অনুমোদন’ করে না।
অর্থাৎ, শুভেন্দুর বিষয়ে দ্রুত দু’টি পদক্ষেপ করেছে বিজেপি। এক, শুভেন্দুকে দিয়েই ঘুরিয়ে তাঁর বক্তব্য প্রত্যাহার করানো। দুই, রাজ্য সভাপতি হিসেবে সুকান্ত স্পষ্ট করে দিয়েছেন শুভেন্দুর কথা দলের বক্তব্য নয়।
এখানেই সিপিএম নেতাদের একটি অংশ ২০১৬ সালে কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতার প্রসঙ্গ টানছেন। পূর্ব বর্ধমানের এক প্রবীণ নেতার কথায়, ‘‘সে বার বিধানসভা ভোটের আগে যখন ওই কাণ্ড চলছিল, তখন কেন্দ্রীয় কমিটি হস্তক্ষেপ করেনি। বাড়তে দিয়েছিল। পরে বলা হয়, কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতার সিদ্ধান্ত দলের লাইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না।’’ সিপিএমের অন্য একটি অংশের বক্তব্য, ‘‘ভোটের আগে কেন্দ্রীয় কমিটি বা পলিটব্যুরোর হস্তক্ষেপ করার কোনও সুযোগই ছিল না। কারণ, বাংলায় কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতার প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রীয় কমিটির একাধিক সদস্য প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন।’’ এ সব তত্ত্বকথার কচকচানির বাইরে গিয়ে সিপিএমের অনেকে তৃতীয় একটি মতও ব্যক্ত করছেন। হাওড়ার এক মধ্যবয়সি নেতার বক্তব্য, ‘‘২০১৬ সালের ভোটের আগে দলের লাইন, পার্টি কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত— এ সব ছিল গৌণ। ভোটে ভাল ফল হলে কেন্দ্রীয় কমিটি কিছু বলত না। যে হেতু ঢক্কানিনাদ করেও হেরে যেতে হয়েছিল, তাই কেন্দ্রীয় কমিটি ভোটের পরে বলেছিল, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সিদ্ধান্ত দলের লাইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। সেটাও ছিল এক ধরনের দ্বিচারিতা।’’
সিপিএম নেতারা একান্ত আলোচনায় মানছেন, আট বছর আগে সাংগঠনিক বাঁধুনি যে ভাবে আলগা হয়েছিল, তার খেসারত এখনও দিতে হচ্ছে। কলকাতার এক প্রবীণ সিপিএম নেতার বক্তব্য, ‘‘আমরা যখন ছাত্র আন্দোলন করি, সেই সময়ে পাড়ার কংগ্রেসিরা আমাদের কটাক্ষ করে বলতেন, তোদের বাসবপুন্নাইয়া যা বলেন, তোরাও পাড়ায় তাই বলিস। সে কথা ছিল আমাদের কাছে গর্বের। কারণ, সংগঠিত পার্টিতে এটাই হওয়া উচিত।’’
অতীতে সিপিএমে বহু প্রশ্নে বহু নেতা দলের লাইনের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, অবস্থান নিয়েছেন। হয় সেই নেতাকে দল থেকে সরে যেতে হয়েছে, না হয় ‘অনুগত’ হিসেবে দলের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হয়েছে। সে সব সিদ্ধান্ত ঠিক না ভুল ছিল তা নিয়ে দলের মধ্যে বিস্তর আলোচনা ছিল এবং রয়েছে। জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রিত্ব নিতে দেয়নি সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটি। দলের মধ্যে ভোটাভুটিতে হেরে গিয়েছিলেন প্রয়াত বসু। তিনি দলের ওই সিদ্ধান্তকে বলেছিলেন ‘ঐতিহাসিক ভুল’। তবে সেই সিদ্ধান্ত মেনেও নিয়েছিলেন। দলেই ছিলেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। বিজেপি বিরোধিতার প্রশ্নে কংগ্রেসের সঙ্গে সর্বভারতীয় স্তরে দলের লাইনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে সিপিএমের সঙ্গে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ বিচ্ছেদ’ করেছিলেন প্রয়াত সৈফুদ্দিন চৌধুরী। ২০০৮ সালে পরমাণু চুক্তির প্রশ্নে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে লোকসভার স্পিকার পদ ছাড়তে বলেছিলেন প্রকাশ কারাটেরা। সেই সিদ্ধান্ত না মানায় সোমনাথকে বহিষ্কার করেছিল সিপিএম। সেই ঘটনা বাঙালি মননে সিপিএম সম্পর্কে ‘নেতিবাচক’ ধারণা তৈরি করেছিল বলেই অনেকে মনে করেন। ঘটনাচক্রে, তার পর থেকেই বঙ্গে সিপিএমের ক্ষয় শুরু। সিপিএম নেতাদের অনেকেই পুরনো ওই সমস্ত ঘটনার কথা উল্লেখ করে বলছেন, ২০১৬ সালের মতো কখনওই সংগঠিত ভাবে শৃঙ্খলাভঙ্গ হয়নি।
অনেকের বক্তব্য, সংগঠিত সব দলেই লাইন বদল হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক অভিমুখ, শত্রু-মিত্র, রণকৌশল বদল হয়। সিপিএমও কংগ্রেসের প্রশ্নে আট বছর আগে যে অবস্থানে ছিল, এখন আর সেখানে নেই। বিজেপিও হয়তো ‘হিন্দুত্ব’কে আগ্রাসী করতে ভবিষ্যতে সাংগঠনিক কাঠামো বা স্লোগানে বদল আনতে পারে। কিন্তু প্রতিটি সংগঠিত দলেই বর্তমান অবস্থানকে মান্যতা দেওয়ার বিষয় রয়েছে। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে শুভেন্দুর প্রশ্নে বিজেপি যে কঠোর অবস্থান নিয়েছে, আট বছর আগে সিপিএম সেই দৃঢ়তা দেখাতে পারেনি। তাই এখন হা-হুতাশ করে কোনও লাভ নেই।