বিজেপি-র নজরে উত্তরবঙ্গ। ফাইল চিত্র
বিধানসভা নির্বাচনের ইস্তাহারে পৃথক উত্তরবঙ্গ রাজ্যের প্রতিশ্রুতি ছিল না বিজেপি-র।অতীতে বিজেপি ছোট রাজ্য গঠনে বেশ কয়েকবার পদক্ষেপ করেছে। তাই রাজনৈতিক মহলের একাংশের মধ্যে এমন জল্পনা ছিল যে, নীলবাড়ির দখল পেলে বাংলাতেও এমন পদক্ষেপের কথা ভাবতে পারে তারা।ক্ষমতায় আসার আশাপূরণ না হলেও ভোটের পর পরই সেই দাবি তুলে ফেলেন দলের বিধায়ক জন বার্লা। পরে তিনি অবশ্য নরেন্দ্র মোদীর মন্ত্রিসভার সদস্য হয়ে গিয়েছেন। উত্তরবঙ্গকে আলাদা রাজ্যের দাবিতে বার্লাকে দল সমর্থন না করলেও রাজ্য স্তর থেকে কেন্দ্রীয় স্তরের বিজেপি নেতারা এটা বলেছেন যে, ‘উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত’ উত্তরবঙ্গের পৃথক হওয়ার দাবি অমূলক নয়। তার পর পরই দলবিরোধী কথা বলার জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে মন্ত্রিত্বের ‘পুরস্কার’ পেয়েছেন। এর পরেও গেরুয়া শিবিরের একের পর এক পদক্ষেপে উত্তরবঙ্গ নিয়ে বিজেপি-র আগামী পরিকল্পনার বিষয়ে জল্পনা বাড়ছে।
সাম্প্রতিক কালে উত্তরবঙ্গকে বিজেপি যে আলাদা গুরুত্ব দিচ্ছে তার আরও কয়েকটি নজির দেখা গিয়েছে। একা বার্লা নন, মন্ত্রিত্ব পেয়েছেন কোচবিহারের সাংসদ নিশীথ প্রামাণিকও। দিনহাটায় মাত্র ৫৭ ভোটে জয় পেলেও কোচবিহার লোকসভা আসনের অন্তর্গত বিধানসভা আসনগুলিরকারণে নিশীথের রিপোর্ট কার্ডবেশ ভাল। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে কোচবিহারে পাঁচটি বিধানসভায় এগিয়ে ছিল বিজেপি। সেখানে এ বার জিতেছে ছ’টিতে। অতিরিক্ত জয়টি এসেছে সিআরপিএফের বুলেট-দীর্ণ শীতলখুচি আসনে।
দার্জিলিংয়ের সাংসদ রাজু বিস্তা এখন বিজেপি যুব মোর্চার সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। লোকসভাতেও বাড়তি গুরুত্ব। নিজস্ব চিত্র
আলাদা রাজ্যের দাবি করে দলকে অস্বস্তিতে ফেলেও পুরস্কৃত বার্লা বিজেপি-র সফলতম সাংসদ। আলিপুরদুয়ারের সাংসদ বার্লা একটা সময়ে ছিলেন আদিবাসী বিকাশ পরিষদের নেতা। বিজেপি-তে যোগ দিয়ে ২০১৯ সালে প্রায় আড়াই লাখ ভোটে জিতেছিলেন। তাঁর আলিপুরদুয়ার লোকসভা এলাকার সাতটি বিধানসভাতেই এগিয়ে ছিল বিজেপি। ২০২১-এর ভোটেও সাতটি আসনে জয় পেয়েছে বিজেপি। রাজ্যে বার্লাই একমাত্র বিজেপি সাংসদ যিনি সাতে সাত পেয়েছেন। তিনি এখন সংখ্যালঘু দফতরের প্রতিমন্ত্রী। বিধানসভা নির্বাচনে মুসলিম ভোট সে ভাবে পায়নি বিজেপি। কিন্তু উত্তরবঙ্গে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশই অমুসলিম। কয়েকটি জেলায় খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বসতি যথেষ্টই উল্লেখযোগ্য।বার্লা নিজেও খ্রিস্টান। দার্জিলিং জেলায় বৌদ্ধ সম্প্রাদায়ের সংখ্যাও বেশ ভাল। ফলে বার্লাকে সংখ্যালঘু দফতরের মন্ত্রী করার পিছনে উত্তরবঙ্গকে গুরুত্ব দেওয়ার ইঙ্গিতও দেখতে পাচ্ছে রাজনৈতিক মহল।
উত্তরবঙ্গকে বেশি করে সর্বভারতীয় স্তরে আলোচ্য করে তোলার লক্ষ্যে আরও দু’জনকে সম্প্রতি পুরস্কৃত করেছে বিজেপি। প্রথম জন দার্জিলিঙের সাংসদ রাজু বিস্তা। লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে এই লোকসভা আসনে সাতের মধ্যে ছয় বিধানসভা কেন্দ্রে এগিয়ে ছিল বিজেপি। বিধানসভা নির্বাচনে একটি আসন কালিম্পং কমেছে। তবুও এটাকে সাফল্য হিসাবে দেখছে বিজেপি। রাজুকে সম্প্রতি বিজেপি যুব মোর্চার সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে। মন্ত্রিত্ব না পেলেও বিজেপি-র পরম্পরা বলছে, যুব মোর্চার সর্বভারতীয় দায়িত্ব মানে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্বের কাছাকাছি থাকা। মোদীর মন্ত্রিসভায় থাকা রাজনাথ সিংহ, ধর্মেন্দ্র প্রধান, অনুরাগ ঠাকুর, জি কৃষ্ণ রেড্ডিরা আগে যুব মোর্চার সর্বভারতীয় দায়িত্বে ছিলেন। আরও বড় কথা, বিজেপি-র সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নড্ডাও তাই।
কোচবিহার থেকে নিশীথ একা নন, গুরুত্ব বেড়েছে তুফানগঞ্জের বিধায়ক মালতি রাভা রায়ের। সর্বভারতীয় দায়িত্ব পেয়ে তিনি হয়েছেন মহিলা মোর্চার সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি। মালতির রিপোর্ট কার্ডও ভাল। নিজে জেতার পাশাপাশি তাঁর জেলা কোচবিহারের ন’টি আসনের মধ্যে সাতটিতেই জিতেছে বিজেপি। ভোট শতাংশের হারেও তৃণমূলের থেকে অনেকটা এগিয়ে এই জেলায় বিজেপি-র ঝুলিতে ৪৯.০৭ শতাংশ।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবিপত্র বালুরঘাটের সাংসদ সুকান্ত মজুমদারের। নিজস্ব চিত্র
উত্তরবঙ্গকে কেন্দ্রীয় বিজেপি-র অধিক গুরুত্ব দেওয়ার শেষ এখানেই নয়। সম্প্রতি মাহলদহে ইংরেজবাজারের বিধায়ক শ্রীরূপা মিত্র চৌধুরী দিল্লিতে একাধিক মন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করে বিভিন্ন দাবি জানিয়েছেন। হাসপাতালের উন্নয়ন থেকে দক্ষিণের সঙ্গে উত্তরবঙ্গের সড়ক পথে যোগাযোগের উন্নয়ন— নানা বিষয়ে তিনি সক্রিয় হয়েছেন। মঙ্গলবার বালুরঘাটের সাংসদ সুকান্ত মজুমদার ভুটানগামী একটি রাস্তার দাবি করে মোদীকে চিঠি দিয়েছেন। সেখানে দাবি করা হয়েছে, ওই রাস্তা তৈরি হলে ভুটান থেকে বালুরঘাটের দূরত্ব ৭৭০ থেকে কমে ১০০ কিলোমিটার হয়ে যাবে। বিজেপি সূত্রে খবর, দলের নীতি মেনেই সুকান্ত, শ্রীরূপাদের এই দাবিদাওয়া। উত্তরবঙ্গকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে চলতি বাদল অধিবেশনে লোকসভায় প্রথম বক্তা হিসেবে বাছা হয় দার্জিলিঙের সাংসদ বিস্তাকে। তাঁর বক্তব্যেউঠে এসেছে উত্তরবঙ্গের জন্য আলাদা পর্যটন প্যাকেজ থেকে মৎস্য চাষ ও ডেয়ারির ক্ষেত্রে উন্নয়নের দাবি। রেলমন্ত্রীর কাছে দার্জিলিং হিমালয় রেলের উন্নয়নে একগুচ্ছ দাবিও জানিয়েছেন।
বিধানসভা নির্বাচনের আগে থেকেই বিজেপি বলে এসেছে, উত্তরবঙ্গ বরাবরই বঞ্চিত। নির্বাচনী ইস্তাহারে আলাদা করে উত্তরবঙ্গের জন্য নানা প্রতিশ্রুতিও ছিল। আলাদা রাজ্য না হলেও পৃথক উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন বোর্ড গঠনের প্রতিশ্রুতি ছিল। ভোটে সাফল্য না মিললেও এখন উত্তরবঙ্গ নিয়ে বিজেপি কি নতুন করে কিছু পরিকল্পনা করছে? এমন প্রশ্নের জবাবে উত্তরবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিজেপি-র রাজ্য সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু বলেন, ‘‘উত্তরবঙ্গের দিকে নজর তো দিতেই হবে। বাম আমল থেকে তৃণমূল জমানা— কোনও সময়েই এখানকার কোনও উন্নয়ন হয়নি। শিল্প বলতে গরু আর মাদক পাচার। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অত্যন্ত করুণ। মন্ত্রী থাকার সময়ে দেবশ্রী চৌধুরী অনেক প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করলেও রাজ্য প্রশাসন তা বাস্তবায়িত করেনি। একই অভিজ্ঞতা সাংসদ সুকান্ত মজুমদার থেকে সুরেন্দ্রসিংহ অহলুওয়ালিয়ার। কিন্তু বিজেপি যে উত্তরবঙ্গকে বরাবর ভাল নজরে দেখেছে সে আর নতুন করে বলার কী। এখন যা যা হচ্ছে এগুলো স্বাভাবিক। আলাদা কিছু নয়।’’
দিল্লিতে বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মন্ত্রী জন বার্লা। ফাইল চিত্র
বিধানসভা নির্বাচনে দক্ষিণবঙ্গের তুলনায় উত্তরে বিজেপি-র ফলঅনেকটাই ভাল। বিধায়ক সংখ্যাই বলে দিয়েছে, দক্ষিণের তুলনায় উত্তরে অনেকটাই ভাল ফল করেছে বিজেপি। ৩০টি আসনে জয় মিলেছে।রাজ্য বিধানসভার যে সব কমিটির চেয়ারম্যন পদ পেয়েও বিজেপি ছেড়ে দিয়েছে, সেখানেও দল বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল উত্তরবঙ্গের বিধায়কদেরই। চেয়ারম্যান মনোনীত আট জনের মধ্যে ছ’জন— দীপক বর্মা, মনোজ টিগ্গা, মিহির গোস্বামী, নিখিলরঞ্জন দে, কৃষ্ণ কল্যাণী এবংবিষ্ণুপ্রসাদ শর্মা উত্তরবঙ্গের বিধায়ক। রাজনৈতিক মহলের বক্তব্য, বিজেপি লোকসভা নির্বাচনে ডিভিডেন্ড পেতে এখন থেকেই উত্তরবঙ্গকে বাড়তি গুরুত্ব দিতে চাইছে। গেরুয়া শিবির সূত্রে খবর, খুব তাড়াতাড়ি উত্তরের সংগঠনেও বেশ কিছু পরিবর্তন আনতে চায় বিজেপি। একই সঙ্গে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বড় মাপের আন্দোলনের পরিকল্পনাও রয়েছে।সংসদের অধিবেশন শেষ হলেই লম্বা সময়ের জন্য উত্তরবঙ্গ সফরের পরিকল্পনা রয়েছে রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষেরও।