বাঁ দিকে বাবুল সুপ্রিয় ও ডান দিকে দিলীপ ঘোষ। —ফাইল চিত্র
গোমূত্র বিতর্কে এ বার ভিন্ন সুর বিজেপির মধ্যেই। জোড়াসাঁকোয় বিজেপি নেতার আয়োজনে গোমূত্র পান করানোর বন্দোবস্ত হয়েছিল দিন কয়েক আগে। দলীয় কর্মসূচি না হলেও রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ সেই কাণ্ডকে সমর্থনই করেছিলেন। কিন্তু রাজ্যেরই আর এক প্রথম সারির বিজেপি নেতা তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় অন্য সুর ধরলেন বৃহস্পতিবার। দিলীপ ঘোষের নাম করলেন না। কিন্তু ঝাঁঝালো টুইটে গোমূত্র পানের বিরোধিতা করলেন। গেরুয়া মানেই বিজেপি নয়— ছুড়লেন এই রকম কটাক্ষও।
বুধবার একটি ভিডিও টুইট করেছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়। সঙ্গীত শিল্পী থেকে রাজনীতিক হয়ে ওঠা বাবুল নিজের গাওয়া একটা বলিউডি গানের দুটো লাইন তুলে ধরেছিলেন সেই ভিডিয়োতে। জনপ্রিয় রোম্যান্টিক গানটায় পরস্পরের কাছাকাছি আসার কথা বলা হলেও আপাতত কারও ও সব করার দরকার নেই, সংক্রমণ এড়াতে দূরত্ব বজায় রাখা দরকার— এই রকম বার্তাই ১ মিনিট ২৫ সেকেন্ডের ভিডিয়োটিতে দিয়েছিলেন আসানসোলের বিজেপি সাংসদ।
বাবুলের সেই টুইটে কমেন্ট করে এক ব্যক্তি ‘গোমূত্র’ কটাক্ষ ছোড়েন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি লেখেন, ‘‘গোমূত্র পান করুন বন্ধু! শক্তিশালী থাকুন।’’ বৃহস্পতিবার সেই মন্তব্যেরই জবাব দিয়েছেন বাবুল সুপ্রিয়। দিল্লিতে হিন্দু মহাসভা আয়োজিত ‘গোমূত্র পার্টি’ হোক বা কলকাতায় বিজেপি নেতার উদ্যোগে গোমূত্র পান করানোর বন্দোবস্ত, কোনওটাতেই যে তাঁর সমর্থন নেই, মন্ত্রী সে বার্তাই দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
আরও পড়ুন: ‘দোকান বাজার বন্ধ নয়, মজুত করলে ব্যবস্থা’, কড়া বার্তা মমতার
গোমূত্র পানের পরামর্শের জবাবে এ দিনের টুইটে বাবুল সুপ্রিয় লিখেছেন, ‘‘আমি ওটা করি না ভাই। যাঁরা ওটা করেন বা সমর্থন করেন, তাঁরা নিজেদের ‘ব্যক্তিগত’ বিশ্বাস থেকে করেন।’’ এতেই থামেননি মন্ত্রী। তিনি লিখেছেন, ‘‘এ কথা ঠিক যে, কেউ কেউ গেরুয়া পরে এটা করেছেন। কিন্তু গেরুয়া মানেই বিজেপি নয়।’’ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ‘বাস্তবসম্মত ভাবে এবং বিজ্ঞানসম্মত ভাবে’ করোনার মোকাবিলার চেষ্টা করছেন এবং ‘সামনে দাঁড়িয়ে’ একজন আন্তর্জাতিক নেতার মতো সেই অভিযানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন— টুইটারে এ দিন এমনও লিখেছেন মোদী মন্ত্রিসভার বাঙালি সদস্য।
বাবুল সুপ্রিয়র এই টুইট কি শুধুমাত্র একটা ট্রোলের জবাব দেওয়ার জন্য? নাকি এই টুইটের বৃহত্তর রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে? তা নিয়েই এ দিন চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছে বাংলার রাজনৈতিক শিবিরে।
জোড়াসাঁকোর বিজেপি নেতা নারায়ণ চট্টোপাধ্যায় সোমবার স্থানীয় লোকজনকে গোমূত্র পান করানোর আয়োজন করার পরে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল, রাজ্য বিজেপির কোনও নেতা প্রথমে সে বিতর্কের দায় নিতে চাননি। দলের অন্যতম রাজ্য সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু সে দিন বলেছিলেন, ‘‘ওটা দলের কোনও কর্মসূচি নয়। বিজেপির রাজ্য নেতৃত্ব বা কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কাউকে বলেননি যে, গোমূত্র খাইয়ে করোনা সংক্রমণ রুখতে হবে। যিনি ওটা করেছেন, তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে করেছেন।’’ কিন্তু মঙ্গলবারই রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষের গলায় ঠিক উল্টো সুর শোনা যায়। দলের অনুমোদন নিয়ে গোমূত্র খাওয়ানো হয়েছে কি না, সে প্রসঙ্গে তিনি যেতেই চাননি সে দিন। গোমূত্র খেলে কোনও ক্ষতি হয় না— এই তত্ত্বই জোর দিয়ে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছিলেন বরং। দিলীপ বলেছিলেন, ‘‘হিন্দুর বাড়িতে যখন সত্যনারায়ণের সিন্নি দেওয়া হয়, তখন পঞ্চগব্য লাগে। তার মধ্যে গোমূত্রও থাকে। হিন্দুদের আরও নানা আচার-অনুষ্ঠানে গোমূত্র ব্যবহার করা হয়। আজ নয়, হাজার হাজার বছর ধরে এটা হয়ে আসছে।’’ গোমূত্র পানে কোনও ক্ষতি হয় না বলে দাবি করে দিলীপ প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘‘এটা কে বলল যে, গোমূত্র খেলে ক্ষতি হয়? হাজার হাজার বছরের পরম্পরা। কার ক্ষতি হয়েছে? গোমূত্র খেয়ে কে অসুস্থ হয়েছেন? ক’জনকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে?’’ দিলীপের ব্যাখ্যা, ‘‘রোজ কত মানুষ গোমূত্র কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। কোটি কোটি টাকার ব্যবসা হচ্ছে। এমনি এমনি তো হচ্ছে না।’’ রাজ্য বিজেপির সভাপতি আরও বলেছিলেন, ‘‘কেউ মনে করেছেন, গোমূত্রে উপকার হতে পারে। তিনি খেয়েছেন। যাঁদের খাইয়েছেন, তাঁদেরও তো জোর করে খাওয়াননি। কী খাওয়াচ্ছেন, জানিয়েই খাইয়েছেন। এতে আপত্তি করার কিছু থাকতে পারে না।’’
আরও পড়ুন: কেন্দ্রের নয়া নির্দেশিকা: ওয়ার্ক ফ্রম হোমে জোর, শিশু-বৃদ্ধরা ঘরে থাকুন
রাজ্য সভাপতির এই বয়ান শুনেই সুর বদলে ফেলেছিলেন রাজ্য বিজেপির অন্যতম সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসুও। সোমবারের অবস্থান থেকে সরে মঙ্গলবার তিনি বলেছিলেন, ‘‘গোমূত্র খেলে কী হয়, সেটা আমরা জানি না। উপকার হয়, নাকি অপকার হয়, জানি না। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখুন না। বিষয়টা নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার।’’
কিন্তু বাবুল সুপ্রিয়র টুইট এ দিন বুঝিয়ে দিল, বিজেপিতে সবাই দিলীপ ঘোষের এই মতকে সমর্থন করতে রাজি নন। বৃহস্পতিবার তাঁর এই টুইট দিলীপ ঘোষের মতের বিরোধিতার লক্ষ্যেই কি না, সে বিষয়ে বাবুল কোনও মন্তব্য করেননি। কিন্তু আনন্দবাজারকে ফোনে তিনি বলেন, ‘‘করোনার মোকাবিলা বৈজ্ঞানিক ভাবে করতে হবে। অন্ধবিশ্বাসের মাধ্যমে নয়।’’ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভূয়সী প্রশংসা করে বাবুল এ দিন বলেন, ‘‘আমরা সবাই দেখতে পাচ্ছি যে, করোনার মোকাবিলায় আমাদের প্রধানমন্ত্রী কী ভাবে শুধু দেশকে নয় বরং সার্ককে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এটাও আমরা দেখছি যে, সম্পূর্ণ বিজ্ঞানসম্মত ভাবে এই সংক্রমণের মোকাবিলা করার বার্তা দিচ্ছেন তিনি। সুতরাং কে কোথায় কোন অন্ধবিশ্বাসকে প্রশ্রয় দেওয়ার চেষ্টা করছেন, সে সব নিয়ে ভেবে লাভ নেই। প্রধানমন্ত্রী যে বার্তা দিচ্ছেন, সেটা ছাড়া আর কোনও বার্তার গুরুত্ব নেই।’’
করোনা সংক্রমণ রোখার নামে বিজেপির কেউ যদি গোমূত্র পান করান বা সেগুলোকে সমর্থন করেন, তা হলে তিনি দলের ভাবমূর্তির ক্ষতি করছেন বলে বাবুলের মত। তবে বিজেপি কোনও ভাবেই গোমূত্র পানকে সমর্থন করে না বলে এ দিন বাবুল বার বার বোঝাতে চেয়েছেন। সে প্রসঙ্গেই নিজের টুইটের কথা তুলে ধরে বলেছেন, ‘‘আগেই বলেছি, যাঁরা গোমূত্র পান করাচ্ছেন, তাঁরা সবাই বিজেপি, এ রকম ভাবার কোনও কারণ নেই। চকচক করলেই যেমন সোনা হয় না, তেমন গেরুয়া হলেই বিজেপি হয় না।’’