ধর্মতলায় ধর্নার এক দিন। ছবি: পিটিআই।
দেরিতে হলেও আরজি করের ঘটনা নিয়ে পথে নেমেছিল রাজ্য বিজেপি। একের পর এক কর্মসূচি নিয়েছে পদ্ম-শিবির। তবে সেই সব কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষ দূরের কথা, দলীয় কর্মীদেরও কি কাছে আনা গিয়েছে? এমন প্রশ্ন উঠেছে বিজেপির অন্দরেই। বৃহস্পতিবার দলের কোর কমিটির বৈঠকে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় বলে বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে। কেন কর্মসূচির সার্বিক সাফল্য মেলেনি দলের নেতারা তার নানা যুক্তিও দিয়েছেন। তবে সে সব বৈঠকে উপস্থিত পর্যবেক্ষক মঙ্গল পাণ্ডে ও সহ-পর্যবেক্ষক অমিত মালব্যরা খুশি হয়েছেন কি না তা জানা যায়নি। কারণ, রাজ্য বিজেপিকে এক মাস আগে আন্দোলনের মধ্যে থাকার বার্তা দেওয়া কেন্দ্রীয় নেতা সুনীল বনসল বৃহস্পতিবারের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না।
প্রসঙ্গত, আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে ১৪ অগস্টের রাত দখল অভিযান পর্যন্ত সে ভাবে পথেই নামেনি বিজেপি। এর পরে শ্যামবাজারে ধর্নায় বসার চেষ্টা করলেও পুলিশের অনুমতি মেলেনি। অবশেষে তা মেলার পরে সুনীল ভার্চুয়াল বৈঠকে রাজ্য নেতাদের ধমকের সুরে কিছু নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে বিজেপি সূত্রেই জানা গিয়েছিল। জানা যায়, সেই বৈঠকে বনসল রাগত স্বরে বলেন, ‘‘এ ভাবে লোক দেখানো আন্দোলন করলে হবে না। রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের চরিত্র এমন হতে পারে না। আন্দোলন করলে তা আন্দোলনের মতো করতে হবে। লোকে যেন বুঝতে পারে।’’
শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ের কাছেই বিজেপির পাঁচ দিনের ধর্না চলে। সেখানে কলকাতা সংলগ্ন প্রতিটি লোকসভা এলাকা থেকে প্রতি দিন ৩০০ করে কর্মী নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু প্রথম দিন থেকেই দেখা যায় কোনও জেলাই লক্ষ্যপূরণ করতে পারেনি। ওই ধর্নার মধ্যেই স্বাস্থ্য ভবন অভিযান হয়। এখনও পর্যন্ত বিজেপি আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে যা যা করেছে তাতে ওই একটি কর্মসূচিই কিছুটা দাগ কাটতে পারে। সুকান্ত মজুমদার, শুভেন্দু অধিকারী, দিলীপ ঘোষ, লকেট চট্টোপাধ্যায়, অগ্নিমিত্রা পাল-সহ দলের সব রাজ্য নেতাই হাজির ছিলেন। তবে কর্মীদের অংশগ্রহণের বিচারে সেই কর্মসূচি মূলত কলকাতারই হয়ে থাকে। এর পরে বিজেপি ২৭ অগস্ট বাংলা বন্ধ ডাকে। তাতে রাজ্যের কোথাও কোথাও সাড়া মিলতে দেখা গেলেও সে ভাবে বিজেপি কর্মীরা বন্ধ সফল করতে রাস্তায় নামেননি।
এর পরে ধর্মতলায় আদালতের অনুমতি নিয়ে ধর্না শুরু করে বিজেপি। প্রথমে ২৯ অগস্ট থেকে ৫ সেপ্টেম্বর এবং পরে ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ধর্না টেনে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয় কলকাতা হাই কোর্ট। শ্যামবাজারের পাঁচ দিনের মতো ধর্মতলার ১৯ দিনের ধর্নাতেও একই চেহারা দেখা যায়। প্রধান নেতাদের উপস্থিত থাকার সময়ে কিছুটা কর্মী সমাগম হলেও দিনভর ফাঁকাই থেকেছে মঞ্চের আশপাশ। মঞ্চে ভিড় হলেও কর্মীদের বসার চেয়ার শূন্যই থেকেছে। এই পরিস্থিতি নিয়ে রাজ্য বিজেপির অনেকেই হতাশ। বৃহস্পতিবারের বৈঠকে সেই হতাশা প্রকাশও করেছেন কেউ কেউ। তবে দুই কেন্দ্রীয় নেতা মূলত শুনেছেন। বিশেষ মন্তব্য করেননি বলেই জানা গিয়েছে।
কিন্তু কেন এমন হল? রাজ্য বিজেপি নেতাদের আলোচনায় মূলত তিনটি যুক্তি উঠে এসেছে। প্রথমত, জেলা স্তরে সংগঠন যে সে ভাবে আর নেই তা স্পষ্ট হয়েছে এই সব কর্মসূচিতে। নাগরিক মিছিলে যোগ দেওয়া কর্মী, সমর্থকদের পতাকার তলায় নিয়ে আসতে পারেনি বিজেপি। ফলে তাঁদের কলকাতার কর্মসূচিতেও আনা যায়নি। এই প্রসঙ্গে এক রাজ্য নেতা বলেন, ‘‘সুকান্ত মজুমদার কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়ে যাওয়ার পরে রাজ্য সভাপতি বদল হবেই। কিন্তু কে হবেন তা এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। এই পরিস্থিতিতে জেলাস্তরের সংগঠনও তাকিয়ে রয়েছে সেই সিদ্ধান্ত ও ঘোষণার দিকে। কারণ, রাজ্য সভাপতি বদল হলে সেখানকার সংগঠনেও বদল আসবে।’’
কর্মীদের দলের কর্মসূচিতে সে ভাবে নিয়ে আসতে না পারার জন্য দ্বিতীয় যে যুক্তি বিজেপি নেতারা দিচ্ছেন তা হল, কলকাতা বা আশপাশের কোনও লোকসভা আসনেই বিজেপি জয় পায়নি। ফলে কর্মীদের মধ্যে হতাশা রয়েছে। সেই সঙ্গে সেই সব আসনে যাঁরা প্রার্থী হয়েছিলেন তাঁরাও সে ভাবে এলাকায় সময় দিচ্ছেন না। আবার সেই সব প্রার্থীর অনেকেই সর্বক্ষণের রাজনীতিক নন। ফলে হাওড়া, হুগলি, দুই ২৪ পরগনার কর্মীদের রাস্তায় নামানো যায়নি।
তৃতীয় যুক্তি নেতাদের অক্ষমতা। ধর্না চলার সময়ে বিভিন্ন দিনে বক্তাদের তালিকায় জেলার নেতাদেরও রাখা হয়েছিল। সেই সঙ্গে বলা হয়েছিল স্থানীয় কর্মীদের নিয়ে আসতে হবে। কিন্তু অনেকেই সেটা করেননি বা করতে পারেননি। রাজ্য বিজেপির এক নেতা নাম করেই বলেন, ‘‘অর্জুন সিংহ যে দিন মঞ্চে ছিলেন সঙ্গে কয়েক গাড়ি লোক নিয়ে এসেছিলেন। তবে সেই সংখ্যাটাও তেমন কিছু নয়। আবার অনেকে লোক আনতে পারবেন না বলে নানা অজুহাত দিয়ে নিজেরাই আসেননি।’’
দলের এ হেন অবস্থায় কেন্দ্রীয় নেতারা পরবর্তী কর্মসূচি নিয়ে কিছুটা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বলেও জানা গিয়েছে। গত ২ সেপ্টেম্বর থেকে দেশের সর্বত্র সদস্য সংগ্রহ অভিযান শুরু করেছে বিজেপি। তবে বাংলায় তা শুরু হবে উৎসবের মরসুম শেষ হওয়ার পরে নভেম্বর মাসে। ইতিমধ্যেই অনলাইন পোর্টাল চালু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সংগঠনের যে চেহারা তাতে সেই বড় কর্মসূচি কতটা সফল করা যাবে তা নিয়ে চিন্তা রাজ্য নেতাদের মধ্যেও রয়েছে। প্রতি ছ’বছর অন্তর বিজেপিতে সদস্য সংগ্রহ অভিযান হয়। দলের হিসাব অনুযায়ী ২০১৯ সালে বাংলায় এক কোটির কিছু বেশি সদস্য হয়েছিল। এ বার তার থেকে কমপক্ষে আট লাখ বৃদ্ধির লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে রাজ্য বিজেপিকে।