ফাইল চিত্র।
জমি থেকে পরিকাঠামো, প্রযুক্তি থেকে সহযোগিতা— সবই রাজ্য সরকারের। সেই জমিতে বিকল্প চাষ করে বাজারের চাহিদামাফিক ফসল ফলানোর সুযোগ পাবেন জমিহীন, পুঁজিহীন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক, কৃষি উদ্যোগপতি ও আগ্রহীরা। প্রশাসনিক ব্যাখ্যায়, এতে এক দিকে অব্যবহৃত জমি থেকে নিশ্চিত আয় হবে সরকারের, অন্য দিকে বিকল্প চাষ করে নিজেদের আয়ও নিশ্চিত করতে পারবেন কৃষকেরা। এই প্রকল্পের নাম ‘প্লাগ অ্যান্ড প্লে’ এবং শিল্প সম্মেলনের আগে এ ভাবেই এই প্রকল্পের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করতে চাইছে রাজ্যের উদ্যানপালন দফতর।
‘বেঙ্গল গ্লোবাল বিজ়নেস সামিট’ বা বিজিবিএস হবে চলতি মাসেই। সেই সম্মেলনে শিল্প মহলের সামনে ছ’টি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রকে তুলে ধরতে চাইছে নবান্ন। কৃষি এবং সহযোগী ক্ষেত্র তার অন্যতম। সরকারি সূত্রের খবর, সম্মেলনে অন্তত ১৪টি দেশের প্রতিনিধিরা থাকতে পারেন। ইংল্যান্ডের শিল্পপতিদের একটি বড় দলেরও আসার কথা। এ দেশের বণিকমহলের সঙ্গে তাদের আলোচনা হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কৃষিজাত পণ্যকে শিল্প-আকর্ষণের আওতায় আনতে প্রয়োজন অভিনব কিছু পদক্ষেপের, যাতে বিপণনযোগ্য শস্যের চাষ যেমন করা যাবে, তেমনই আয় বাড়ানো সম্ভব প্রান্তিক চাষিদের। তবেই এই ধরনের ফসলের চাষে কৃষকের আগ্রহ বাড়বে এবং কাঙ্ক্ষিত ফলন সম্ভব হবে বলে মনে করছে সরকার। বিশেষজ্ঞদের মতে, সে-দিক থেকে এই পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ।
কী এই ‘প্লাগ অ্যান্ড প্লে’ প্রকল্প?
প্রশাসনিক কর্তারা জানাচ্ছেন, রাজ্যের কৃষি খামারগুলিতে অনেক জমি অব্যবহৃত অবস্থায় রয়েছে। অথচ জমিগুলি উর্বর। নদিয়া, বাঁকুড়া, জলপাইগুড়ি, হুগলি, পূর্ব মেদিনীপুর, মালদহ, দার্জিলিং-কালিম্পং মিলিয়ে ১২টি খামারে প্রায় ৪০০ একর জমি রয়েছে। প্রাথমিক ভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছে, নদিয়ার আয়েশপুর ও কৃষ্ণনগর, বাঁকুড়ার বড়জোড়া ও তালডাংড়া, জলপাইগুড়ির মোহিতনগর, হুগলির চুঁচুড়া ও শূরপাড়া, পূর্ব মেদিনীপুরের দিঘা, কাজলাগড়, রামনগর এবং মালদহের ইংরেজবাজারের খামারে এই প্রকল্পের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ হবে। এতে ১০০০ বর্গমিটার বা প্রায় ১৫ কাঠার প্রতিটি প্লট বা ভূমিখণ্ডে চাষের পুরো প্রযুক্তি-পরিকাঠামো প্রস্তুত থাকবে। ইচ্ছুক কৃষকেরা আবেদনের ভিত্তিতে চাষের সুযোগ পাবেন সেখানে। প্রাথমিক ভাবে তিন বছরের জন্য চাষের অনুমতি পেলে কৃষক সেখানে অসময়ের ফসল এবং অর্থকরী আনাজ ফলাতে পারবেন। আধুনিক চাষ সম্পর্কে পরামর্শদানের সুবিধাও থাকবে সেখানে। জমি ব্যবহারের ন্যূনতম ভাড়া দিতে হবে কৃষককে। তার বদলে তিনি উৎপাদিত ফসল বাজারজাত করে আয় করতে পারেন। কৃষক চাইলে সরকারি ফসল সংগ্রহের প্রক্রিয়ার সঙ্গেও তাঁকে যুক্ত করে নিতে পারে উদ্যানপালন দফতর।
প্রশাসনের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “সাধারণ জমিতে চাষ করলে যে-আয় হয়, তার তুলনায় এই ধরনের ভূমিখণ্ডে অন্তত আড়াই থেকে তিন গুণ বেশি আয় করতে পারবেন সংশ্লিষ্ট কৃষকেরা। এই পদ্ধতি সফল হলে আগামী দিনে এর পরিধি আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে রাজ্য সরকারের। তাদের লক্ষ্য, আধুনিক চাষের ধারণা ছড়িয়ে দেওয়া।”
কৃষি বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, ক্যাপসিকাম, লেটুস, ব্রোকোলি বা স্যালাডে ব্যবহৃত আনাজের চাহিদা বাজারে অনেক বেশি। চাষের গুণমান ঠিক থাকলে আন্তর্জাতিক বাজারের জন্যও সেগুলি রফতানিযোগ্য করে তোলা সম্ভব। আবার কপি, টোম্যাটো, ধনেপাতার মতো কিছু আনাজের চাহিদা অনেক বেশি থাকে অসময়েও। দামও পাওয়া যায় তুলনায় অনেক বেশি। ফলে ন্যূনতম ভাড়ার পরিবর্তে এত কিছু চাষের সুযোগ পেলে যে-কোনও কৃষকের পক্ষেই নতুন প্রকল্প লাভজনক হবে। আবার পণ্য বাজারজাত করার ক্ষেত্রেও তেমন সমস্যা পোহাতে হবে না তাঁকে।
প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকেরা জানান, বড় কৃষকদের আয়ে ততটা সমস্যা নেই। কিন্তু ক্ষুদ্র বা প্রান্তিক কৃষক অথবা উদ্যোগপতিদের পর্যাপ্ত জমি, পুঁজি, পরিকাঠামো, প্রযুক্তি, সর্বোপরি আধুনিক চাষের জ্ঞান তেমন না-থাকায় বাজারে (জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরেও) চাহিদাসম্পন্ন শস্য চাষে ঘাটতি থেকে যায়। রফতানিযোগ্য ফসলের চাষ বাড়ানোর মতো পরিবেশ তৈরি করা গেলে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে বিনিয়োগ সম্ভাবনাও অনেকটাই বেড়ে যাবে এবং রাজ্য সরকার সেটাই চাইছে।