ঝড়ে গাছপালা ভেঙে পড়বে। ঘনঘন বজ্রপাতে কেঁপে উঠবে বাড়ি। বিকেলে ঘন কালো আকাশের বুকে থেকে থেকে ঝলক দেবে বিদ্যুৎ। তার পরে এক সময়ে হুড়মুড়িয়ে নামবে বৃষ্টি।
এগুলোই ছিল তার চরণচিহ্ন। এই সব দিয়েই চেনা যেত তাকে। কিন্তু কালবৈশাখীর এত দিনকার পরিচিত সেই চেহারাটাই যেন বদলে গিয়েছে!
চলতি মরসুমে এখনও এক বারের জন্যও এই সব বৈশিষ্ট্যে ভরপুর ‘পরিণত’ কালবৈশাখীর দেখা পায়নি দক্ষিণবঙ্গ। রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলি গোটা পাঁচেক কালবৈশাখী পেলেও তার কোনওটাতেই পর্যাপ্ত বৃষ্টি হয়নি। তাই শুখা পরিস্থিতির বদল হয়নি। ভূগর্ভস্থ জলস্তরের শনৈ শনৈ অধোগতি বন্ধ হয়নি কোথাও। শুকিয়ে গিয়েছে সব পুকুর-ডোবা-খালবিল। মফস্সলের যদি এই দশা হয়, কলকাতার বরাত আরও খারাপ। কারণ একটাও পরিপূর্ণ কালবৈশাখী হয়নি মহানগর-সহ এই এলাকায়। তাই একটানা অস্বস্তিকর আবহাওয়ায় ভুগতে হচ্ছে বাসিন্দাদের।
আবহবিদেরা জানাচ্ছেন, এই সময়ে শিলাবৃষ্টিও অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু এ বার শিলাবৃষ্টিও হয়েছে তুলনায় অনেক কম। গরম হাওয়া উপরের দিকে উঠতে উঠতে যখন খুব উঁচুতে উঠে যায়, উল্লম্ব মেঘের মধ্যে থাকা জলীয় বাষ্প তখন জমতে জমতে বরফের আকার নেয়। সেই অবস্থায় উল্লম্ব মেঘ সরতে থাকে। যেখানে সে ভেঙে যায়, সেখানেই বৃষ্টির ফোঁটার সঙ্গে ছোট ছোট বরফের টুকরো নেমে আসে ভূপৃষ্ঠে। সেটাই শিলাবৃষ্টি।
আরও পড়ুন: আরও স্মার্ট মেদিনীপুর
সাধারণত তাপমাত্রা লাগাম ছাড়ালে মাটি থেকে গরম হাওয়া দ্রুত উপরে দিকে উঠতে থাকে। সে-ক্ষেত্রে শিলাবৃষ্টির সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু এ বার এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের পরে রাঢ় বাংলার তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে ওঠেনি বলেই জানাচ্ছেন আবহবিদেরা। তাঁদের ব্যাখ্যা, তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির মাত্রা ছাড়ায়নি বলেই মাটি তেমন তেতে উঠতে পারেনি। ফলে তেমন গরম হয়নি মাটির কাছাকাছি থাকা বাতাস। তাই তা বেশি উপরে উঠতে পারেনি। রাঢ় বাংলার কোথাও কোথাও তাপমাত্রা যখন ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি পৌঁছেছে, একমাত্র তখনই তৈরি হয়েছে কালবৈশাখী। কিন্তু সেই গরম বাতাস খুব বেশি উপরে না-ওঠায় শিলাবৃষ্টির পরিমাণ এ বার ছিল তুলনায় অনেক কম।
জেলায় কয়েকটা মাঝারি মানের কালবৈশাখী হলেও কলকাতার বরাত খারাপ। মহানগরী এবং সংলগ্ন এলাকায় গত ১৫ দিনে তিনটি কালবৈশাখী হলেও তাতে তেমন জোরই ছিল না। কালবৈশাখী বলতে যে-দুরন্তের অশান্তপনা বোঝায়, তার দেখা মেলেনি। বিকেলে আকাশে এমন ঘন মেঘ জমেনি, যাতে ঘরের সব আলো জ্বালিয়ে রাখতে হয়। ঝড় যেটুকু যা হয়েছে, তা ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটারের মাত্রা ছাড়ায়নি এক বারও। ‘অপরিণত’ কালবৈশাখীতে বৃষ্টি হয়নি বললেই চলে।
আবহবিদদের পরিসংখ্যান বলছে, এ বার এখনও পর্যন্ত কলকাতা এবং সংলগ্ন এলাকায় থার্মোমিটারের পারদ এক বারের জন্যও ৪০ ডিগ্রি ছোঁয়নি। ৩৯ ডিগ্রির কাছাকাছি এসেছিল এক দিন। ৩৮ ডিগ্রি তাপমাত্রা ছিল দিন সাতেক। কিন্তু টানা দু’তিন দিন ৩৮ ডিগ্রি থাকেনি কখনও। পারদ ঘোরাফেরা করেছে ৩৬-৩৭ ডিগ্রির মধ্যেই। তার কারণ, বায়ুপ্রবাহের ঘনঘন পরিবর্তনে বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয় বাষ্প ঢোকায় আকাশে মেঘ জমে থেকেছে। কিন্তু সেই মেঘ থেকে বৃষ্টি নামানোর জন্য যে-প্রাকৃতিক অনুঘটকের প্রয়োজন ছিল, সেটা গরহাজির। তার অনুপস্থিতিতেই বৃষ্টি হচ্ছে না। মানুষ ঘেমেনেয়ে একশা।
আকাশে মেঘ দেখলেও তাই আর আশ্বস্ত হতে পারছে না কলকাতা।