রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস। ফাইল চিত্র।
তিনি বাংলার রাজ্যপাল হয়েছেন এক মাস আগে, নভেম্বরের ২৩ তারিখে। এরই মধ্যে সেই রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোসকে কার্যত তৃণমূলের প্রতি ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ বলে দিল্লির কাছে নালিশ জানাতে শুরু করল রাজ্য বিজেপি। আর তার পুরোধা বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলে বিজেপি সূত্রের খবর।
বিজেপি সূত্রের দাবি, সম্প্রতি দিল্লিতে দলের সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নড্ডার সঙ্গে রাজ্য নেতৃত্বের বৈঠকে শুভেন্দু রাজ্যপালের ভূমিকা নিয়ে ‘অসন্তোষ’ জানান এবং সেখানে তিনি বলেন, অতীতে রাজ্যপালের দফতর থেকে যে ভাবে সাহায্য পাওয়া যেত, এখন সে ভাবে সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে না। পরিবর্তে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসকে অনেক বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন নতুন রাজ্যপাল।
বোসের পূর্বসূরি জগদীপ ধনখড় সম্পর্কে ঠিক এই অভিযোগ তুলত শাসক তৃণমূল। তৃণমূলের জাতীয় মুখপাত্র সুখেন্দুশেখর রায়ের পাল্টা বক্তব্য, ‘‘বিজেপি যদি ভেবে থাকে সব রাজ্যপালই অতীতের জগদীপ ধনখড়ের মতো বিজেপির মুখপাত্র হিসেবে কাজ করবেন, তা হলে তাঁরা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন।’’
রাজ্যপাল হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র বিক্ষোভ থেকে তৎকালীন বিজেপি মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়কে উদ্ধার করতে ছুটে গিয়েছিলেন ধনখড়। নিশানায় বিদ্ধ করেছিলেন প্রশাসন ও শাসক দলকে। সেই সূচনা। তার পর থেকে বছর দুয়েক টানা তাঁর সঙ্গে নবান্ন ও শাসক দলের সংঘাত পৌঁছেছিল চরমে। বিরোধী দলনেতা হওয়ার পরে শুভেন্দু এবং অন্য বিজেপি নেতারা নিয়মিত ধনখড়ের কাছে অভিযোগ জানাতে যেতেন। এবং রাজ্যপাল
হিসেবে ধনখড় তার ভিত্তিতে নানা ভাবে সরকার ও এবং শাসক তৃণমূলকে প্রশ্নের মুখে ফেলতেন। কখনও তা হুমকির পর্যায়েও যেত। তখন তৃণমূল রাজ্যপালের ভূমিকা সম্পর্কে নালিশ জানাত প্রধানমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে।
এ বার বিপরীত ছবি রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কাছে তাই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। ধনখড়ের আমলে রাজ্যপালের দফতর বিজেপির দলীয় দফতরে পরিণত হয়েছিল বলে সরব হয়েছিল তৃণমূল। বিজেপি সূত্রের খবর, এ যাত্রায় শুভেন্দু শিবিরের দাবি, নতুন জমানায় তৃণমূলের দলীয় দফতরে পরিণত হয়েছে রাজ্যপালের দফতর। সুখেন্দুশেখর এ দিন পাল্টা বলেন, ‘‘রাজ্যপাল হিসেবে ধনখড় সম্পর্কে আমরা যা বলেছিলাম, তা বিজেপি নেতাদের এই অভিযোগেই প্রমাণিত।’’ তাঁর আরও মন্তব্য, ‘‘আনন্দ বোস দীর্ঘ দিন প্রশাসনের উচ্চপদে কাজ করেছেন। তাই তাঁর উপর আস্থা রাখছি।’’
গত সোমবার নড্ডার সঙ্গে রাজ্য নেতাদের বৈঠক হয়েছিল দলীয় সাংসদ সুভাষ সরকারের বাড়িতে। সেখানে সাংসদেরা ছাড়াও ছিলেন শুভেন্দু অধিকারী, সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) অমিতাভ চক্রবর্তী। উল্লেখ্য, বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার ও সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষও সাংসদ। আনন্দ বোস সম্পর্কে শুভেন্দুর মতামত নিয়ে কেউ কোনও মন্তব্য করেননি বলে খবর।
প্রাক্তন আইএএস বোস রাজ্যপাল হওয়ার পরে বৃহস্পতিবার তাঁর সঙ্গে প্রথম আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যপালের ভূয়সী প্রশংসা করে তিনি বলেছেন, ‘‘এই রাজ্যপাল প্রকৃত অর্থে ভদ্র মানুষ। উনি রাজ্য সরকারকে সহযোগিতা করছেন।’’ শুক্রবারই আবার বিধানসভায় পুষ্প প্রদর্শনীর উদ্বোধন করে রাজ্যপাল রাজ্যের অগ্রগতির স্বার্থে শাসক-বিরোধী সকলের সম্মিলিত উদ্যোগের উপরে গুরুত্ব দেন। বলেন, ‘‘স্পিকার এই যে পুষ্প প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন, তার নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য রয়েছে। আসলে নানা রকম ফুলকে এক জায়গায় এনে তোড়া তৈরির মতোই বিধানসভায় নানা মতকে এক জায়গায় আনার কাজ তাঁকেই করতে হয়।’’ আনুষ্ঠানিক বক্তব্যের বাইরে রাজ্যের সঙ্গে রাজ্যপালের সম্পর্কের বিষয়ে কোনও প্রশ্নের উত্তর তিনি দিতে চাননি। ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলে চলে যান।
বিধানসভার ওই অনুষ্ঠানে বিজেপির কোনও বিধায়ক ছিলেন না। রাজ্যপালকে নিয়ে দলনেতা শুভেন্দুর ‘অসন্তোষ’ এর পিছনে কাজ করেছে কি না, তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে চর্চা চলছে। বিজেপি সূত্রের খবর, দিল্লির দলীয় বৈঠকে গরু-কয়লা পাচার, নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিকে আরও বেশি সক্রিয় ভূমিকা নেওয়ার জন্য সওয়াল করেন শুভেন্দু এবং কর্মীদের মনোবল বাড়াতে দুর্নীতিতে অভিযুক্ত তৃণমূলের বড় মাপের বেশ কিছু নেতাকেও অবিলম্বে গ্রেফতার করার দাবি তোলেন। বৈঠকে উপস্থিত এক সাংসদের পাল্টা দাবি, ‘‘কেন্দ্রীয় এজেন্সি বা আদালতের সাহায্যে রাজ্যে ক্ষমতা পরিবর্তন হয় না। সংগঠন যত দিন শক্তিশালী না হবে, তত দিন ক্ষমতার পরিবর্তন হওয়া অসম্ভব।’’
কিন্তু সংগঠন নিয়ে সে দিনের বৈঠকে বিভিন্ন সাংসদের সমালোচনার মুখে পড়তে হয় অমিতাভ চক্রবর্তীকে। একাধিক বিজেপি সাংসদ ওই বৈঠকে নাম না করে তাঁর ভূমিকার সমালোচনা করেন। সব থেকে বেশি সরব ছিলেন বনগাঁর সাংসদ শান্তনু ঠাকুর। তাঁর অভিযোগ, সাংগঠনিক ঢিলেমির কারণে তাঁর এলাকায় শুধু জেলা সভাপতি রয়েছেন। বুথ কমিটি তো দূরে থাক, মণ্ডল কমিটি পর্যন্ত তৈরি হয়নি। সাংগঠনিক সমস্যা নিয়ে সরব হন নিশীথ অধিকারী, সৌমিত্র খাঁ, জগন্নাথ সরকারেরা। সূত্রের মতে, বৈঠকে নড্ডা রাজ্য নেতৃত্বকে গোষ্ঠী বিবাদ ভুলে দলের স্বার্থে এক জোট হয়ে কাজে জোর দেন। বিজেপির এক সাংসদের কথায়, ‘‘সে দিন সাংগঠনিক দুর্বলতার বিষয়ে সাংসদেরা যে ভাবে সরব হন, তাতে নড্ডা বুঝেছিলেন, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব কতটা প্রবল। ফলে ক্রমশ মনোবল হারাচ্ছেন কর্মীরা।’’